1. onemediabd@gmail.com : admin2 :
  2. info@www.dhanershis.net : ধানের শীষ :
ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর: বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও বিএনপির আগামীর রাষ্ট্র ভাবনা - ধানের শীষ
শুক্রবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৫, ০১:২১ অপরাহ্ন
সর্বশেষ :
জিয়াউর রহমানের মাজারে সর্বস্তরের জনতার ঢল, পুষ্পস্তবক অর্পণ ও ফাতেহা পাঠ জুলাই সনদের ঐকমত্যের আইনানুগ বাস্তবায়নের আহ্বান বিএনপির ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর: বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও বিএনপির আগামীর রাষ্ট্র ভাবনা বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমানের মনোনয়ন ও তারেক রহমানের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা মাদারীপুর-১ আসনে কামাল মোল্লার মনোনয়ন স্থগিত বিএনপিতে যোগ দিলেন শহীদ মীর মুগ্ধের ভাই স্নিগ্ধ বিএনপি মহাসচিবের সঙ্গে মিশরীয় রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ জোট করলেও নিজ দলের প্রতীকে ভোট, অধ্যাদেশ জারি মনোনয়নকে কেন্দ্র করে সহিংসতা, বিএনপির চার নেতা বহিষ্কার ২৩৭ আসনে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা

ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর: বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও বিএনপির আগামীর রাষ্ট্র ভাবনা

মোহাম্মদ এহছানুল হক ভূঁইয়া
  • প্রকাশিত: শুক্রবার, ৭ নভেম্বর, ২০২৫
  • ৩৩ বার পড়া হয়েছে

মোহাম্মদ এহছানুল হক ভূঁইয়া

বাংলাদেশের রাষ্ট্রগঠনের ইতিহাস মূলত তিনটি স্তরে বিভক্ত — মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা-পরবর্তী পুনর্গঠন, এবং রাজনৈতিক আদর্শের পুনঃসংজ্ঞা।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বাংলাদেশের রাষ্ট্রচিন্তায় এমন এক ঘটনাপ্রবাহের সূচনা করে যা পরবর্তী চার দশকে রাষ্ট্রনীতি, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, দলীয় রাজনীতি এবং জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

১৯৭১ সালের পর জাতি যখন একদলীয় রাজনৈতিক কেন্দ্রিকতা, রাজনৈতিক দমননীতি ও অর্থনৈতিক স্থবিরতার মুখোমুখি, তখন ৭ নভেম্বরের সৈনিক-জনতার আন্দোলন রাষ্ট্রের কাঠামোগত দিকপালন পরিবর্তনের সূচনা করে। এর পরেই আবির্ভূত হয় বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ — একটি নতুন রাষ্ট্রচেতনা যা বাংলাদেশের ভূখণ্ড, ধর্মীয় অনুভব, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার মেলবন্ধন ঘটায়।

এই লেখা এবং ভাবনার উদ্দেশ্য হলো —

(ক) ৭ নভেম্বরের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা,
(খ) “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ” এর আদর্শিক ভিত্তি বিশ্লেষণ করা,
(গ) বিএনপির রাষ্ট্রচিন্তার বিবর্তন ও আগামীর রাজনৈতিক দর্শন মূল্যায়ন করা।

২. লেখার উদ্দেশ্য
২.১ উদ্দেশ্য
এই লেখার মূল উদ্দেশ্য হলো ৭ নভেম্বরের রাজনৈতিক ঘটনাবলির আলোকে “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ” ধারণার তাত্ত্বিক উৎস ও প্রভাব বিশ্লেষণ করা, এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ রূপরেখায় বিএনপির ভূমিকা অনুসন্ধান করা।

২.২ অনুসন্ধান মূলক প্রশ্নাবলী :
১. ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ কীভাবে জাতীয় রাজনীতির মোড় পরিবর্তন করেছিল?
২. “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ” ধারণাটি কীভাবে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’-এর বিকল্প রাজনৈতিক দর্শন হয়ে ওঠে?
৩. বিএনপি এই আদর্শের বাস্তব প্রয়োগে কতটা সফল হয়েছে?
৪. ভবিষ্যতের রাষ্ট্রচিন্তায় এই জাতীয়তাবাদ কী ভূমিকা রাখতে পারে?

৩. ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও ৭ নভেম্বরের উত্থান
৩.১ ১৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক সংকট
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর রাষ্ট্র প্রশাসন একটি ভয়াবহ শূন্যতার মধ্যে পড়ে।
একদলীয় শাসনব্যবস্থা (বাকশাল) বিলুপ্ত হলেও প্রশাসনিক কাঠামো ছিল বিপর্যস্ত। সেনাবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ ও বিভক্তি তীব্র হয়ে ওঠে।
৩.২ সৈনিক-জনতার ঐক্য
৭ নভেম্বর ১৯৭৫-এ কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর এক অংশ ও সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণে জিয়াুর রহমানকে মুক্ত করা হয়।
এই দিনটিকে বিএনপি ইতিহাসে ‘সিপাহী-জনতার বিপ্লব’ এবং অন্য অংশ এটি ‘ক্যু’ বলে আখ্যায়িত করে।
তবে নিরপেক্ষ বিশ্লেষণে দেখা যায় — এটি ছিল ক্ষমতার পুনর্বিন্যাসের পাশাপাশি রাষ্ট্রের নতুন দর্শন প্রতিষ্ঠার সূচনা।
৩.৩ জিয়াউর রহমান ও নতুন রাষ্ট্রদর্শনের উত্থান
জিয়াউর রহমান এই ঘটনাকে “জাতীয় পুনর্জাগরণের দিন” হিসেবে দেখেন।
তিনি ১৯৭৬–১৯৭৭ সালে রাষ্ট্রচিন্তায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন —
“বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ” শব্দবন্ধের প্রবর্তন,
বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন,
সংবাদপত্র ও রাজনৈতিক দলগুলোর পুনরায় নিবন্ধন,
পল্লী উন্নয়ন, শিক্ষা ও কৃষি অর্থনীতিতে নীতি সংস্কার।
এগুলো রাষ্ট্রের সামাজিক শৃঙ্খলা পুনঃস্থাপনে বড় ভূমিকা রাখে।

৪. ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’: ধারণা, উৎস ও আদর্শিক ভিত্তি
৪.১ ধারণার উৎপত্তি
‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ প্রথম প্রকাশ্যে ব্যবহার করেন জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের এক ভাষণে।
এর মাধ্যমে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের সীমিত জাতিসত্তাকে অতিক্রম করে বাংলাদেশের ভূখণ্ডকেন্দ্রিক, ধর্ম-সংস্কৃতি-সমন্বিত জাতিসত্তার কথা বলেন।
এটি মূলত territorial nationalism ও cultural pluralism–এর এক সংমিশ্রণ।
৪.২ মূল দর্শন
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ তিনটি মূল স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে —
1. ভূখণ্ড ও সার্বভৌমত্বের এককতা
2. ইসলামী মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্তি
3. গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক ন্যায় ও সামাজিক সংহতি
এই দর্শন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিচয়কে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য জাতীয়তাবাদী মডেল (যেমন ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতা বা পাকিস্তানি ইসলামিক ন্যাশনালিজম) থেকে পৃথক করে।

৫. বিএনপি: রাষ্ট্রচিন্তার বাস্তবায়ন ও সীমাবদ্ধতা
৫.১ প্রতিষ্ঠা ও কাঠামো
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, যার মূলমন্ত্র ছিল —
“বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, ইসলামিক মূল্যবোধ, গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক ন্যায়।”
১৯৭৯ সালের নির্বাচনে দলটি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় এবং সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমে বহুদলীয় রাজনীতি পুনঃপ্রবর্তন করে।
৫.২ অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সংস্কার
জিয়াউর রহমান এবং পরে খালেদা জিয়া সরকারের সময়—
বেসরকারি খাতের উন্মুক্তকরণ,
রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন,
গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ,
স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ—
এসব সংস্কার বাস্তবায়িত হয়, যা ৭ নভেম্বরের চেতনার ধারাবাহিকতা।

৫.৩ সীমাবদ্ধতা ও সমালোচনা
প্রশাসনিক কেন্দ্রিকতা ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীভিত্তিক সংঘাত,
দুর্নীতির অভিযোগ,
দলীয় রাজনীতিতে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের অভাব,
এসব কারণে দলের ভাবমূর্তি বহুবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তবু দলটির দর্শন এখনো বাংলাদেশে জাতীয় ঐক্য ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রধান ভিত্তি হিসেবে টিকে আছে।

৬. সমসাময়িক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট (২০২৫): পুনঃপ্রাসঙ্গিকতা
২০২৫ সালের বাংলাদেশের রাজনীতি এক নতুন সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে —
নির্বাচনী স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণের সংকট,
প্রশাসনিক নিরপেক্ষতার অভাব,
নাগরিক স্বাধীনতার প্রশ্ন,
আন্তর্জাতিক চাপ ও মানবাধিকার মনিটরিং —
এই প্রেক্ষাপটে “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ” পুনরায় আলোচনায় এসেছে।

বিএনপি এই আদর্শকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করছে —
গণতন্ত্র, আইনের শাসন, অর্থনৈতিক সাম্য ও সামাজিক সম্প্রীতির সমন্বয়ে এক inclusive nationalism।

৭. বিএনপির আগামীর রাষ্ট্র ভাবনা: কাঠামোগত বিশ্লেষণ
৭.১ রাজনৈতিক নীতি
নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন
অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাচন সরকার ব্যবস্থা
সংবিধান সংস্কার ও ক্ষমতার ভারসাম্য
৭.২ অর্থনৈতিক রূপরেখা
উৎপাদনভিত্তিক অর্থনীতি
বেকারত্ব হ্রাস ও দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন
ডিজিটাল ও সবুজ অর্থনীতির সমন্বয়
৭.৩ সামাজিক ও মানবাধিকার কাঠামো
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা
মানবাধিকার কমিশনের স্বায়ত্তশাসন
৭.৪ সাংস্কৃতিক রাষ্ট্রচিন্তা
ইসলামিক মূল্যবোধ, ভাষা ও সংস্কৃতির সহাবস্থান
সংখ্যালঘু ও জাতিগত গোষ্ঠীর অধিকার সুরক্ষা
মুক্তিযুদ্ধের বহুমাত্রিক বর্ণনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা

৮. বিশ্লেষণ ও আলোচনাসূত্র
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে অনেক গবেষক “inclusive conservatism” বলে অভিহিত করেন — এটি এমন এক জাতীয়তাবাদ যা প্রথা ও আধুনিকতার মধ্যে সেতুবন্ধন ঘটাতে চায়।
এর সবচেয়ে বড় শক্তি হলো, এটি ধর্মকে সমাজ-সংহতির উপাদান হিসেবে দেখে, বিভেদের উৎস হিসেবে নয়।
এই দর্শন, যদি সত্যিকারভাবে গণতান্ত্রিক নীতিতে পরিণত হয়, তবে এটি দক্ষিণ এশিয়ায় এক অনন্য রাজনৈতিক মডেল হতে পারে।
তবে এর জন্য দরকার —
রাজনৈতিক সহনশীলতা,
বিচারিক স্বচ্ছতা,
এবং দলীয় সংস্কারের ধারাবাহিকতা।

৯. শেষ অংশ
৭ নভেম্বর কেবল অতীতের একটি ঘটনা নয়; এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রচিন্তার এক স্থায়ী প্রতীক।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ আমাদের শেখায় — স্বাধীনতা তখনই অর্থবহ যখন তা নাগরিকের অংশগ্রহণ, ন্যায়বিচার ও স্বাধীন মতপ্রকাশের নিশ্চয়তা দেয়।
বিএনপি এই দর্শনকে যদি আধুনিক প্রেক্ষাপটে প্রযুক্তিনির্ভর, মানবিক ও ন্যায়সঙ্গত রূপে রূপান্তর করতে পারে, তবে এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে নতুন গতি দিতে পারে।
৭ নভেম্বরের চেতনা তাই আজও প্রাসঙ্গিক —
এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, রাষ্ট্র মানে শুধু ক্ষমতা নয়; রাষ্ট্র মানে জনগণের অংশগ্রহণে গঠিত এক ন্যায়ভিত্তিক ঐক্য।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ৭ নভেম্বর এমন একটি দিন, যা কেবল একটি রাজনৈতিক ঘটনাকে নির্দেশ করে না; বরং এটি রাষ্ট্রদর্শনের এক মৌলিক পরিবর্তনের সূচনা করে। ১৯৭৫ সালের এই দিনেই উদ্ভূত হয় “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ” — এক নতুন জাতীয় চেতনা, যা পরবর্তীকালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর রাজনৈতিক দর্শন ও রাষ্ট্রচিন্তার মূল ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
৭ নভেম্বরের ঘটনাকে কেউ “সিপাহী-জনতার বিপ্লব” বলে, কেউ “অভ্যুত্থান” বলে চিহ্নিত করেছেন; কিন্তু এর গভীরে নিহিত ছিল রাষ্ট্রচিন্তার এক নতুন দিকনির্দেশ — একটি জাতি, যা তার ভূখণ্ড, সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাস ও ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে নতুনভাবে নিজেকে সংজ্ঞায়িত করে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা
১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতার পর জাতি এক বিশাল প্রত্যাশা নিয়ে নতুন রাষ্ট্রগঠনের অভিযাত্রা শুরু করে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই একদলীয় শাসনব্যবস্থা, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা জনগণের প্রত্যাশাকে ভেঙে দেয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা ও সেনা অসন্তোষের মধ্য দিয়ে দেশ এক অনিশ্চিত পথে পড়ে। এই প্রেক্ষাপটেই ৭ নভেম্বর ১৯৭৫-এ সংঘটিত হয় এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন — সেনাবাহিনীর একাংশ ও সাধারণ জনতার অংশগ্রহণে শহীদ জিয়াউর রহমান মুক্ত হন এবং রাষ্ট্রচিন্তার নতুন ধারা প্রতিষ্ঠার সূচনা করেন।

বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের উত্থান: এক নতুন রাষ্ট্রচেতনা
জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ” ধারণাটি প্রবর্তন করেন।
এটি ছিল পূর্বতন “বাঙালি জাতীয়তাবাদ”-এর বিপরীতে এক বিস্তৃত রাষ্ট্রদর্শন, যা শুধু জাতিগত বা ভাষাভিত্তিক নয়, বরং ভূখণ্ড, ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে গঠিত।
এর মূল তিনটি স্তম্ভ হলো —
১.ভূখণ্ডগত একতা ও সার্বভৌমত্ব,
২.ইসলামী মূল্যবোধ ও দেশীয় সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্তি,
৩.সামাজিক ন্যায়, গণতন্ত্র ও অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন।
এই আদর্শের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য জাতীয়তাবাদী মডেল থেকে পৃথক করে একটি territorial and inclusive nationalism-এর ধারণা প্রতিষ্ঠা করেন।
৭ নভেম্বরের চেতনা ও রাষ্ট্রনীতির পুনর্গঠন
৭ নভেম্বরের চেতনা মূলত রাষ্ট্র ও জনগণের পারস্পরিক নির্ভরতার দর্শনকে পুনরুজ্জীবিত করে।
জিয়াউর রহমান এই চেতনার ভিত্তিতে রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেন।
তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করেন, সংবাদপত্র ও রাজনৈতিক সংগঠনকে পুনরায় বৈধতা দেন, এবং প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ, পল্লী উন্নয়ন ও শিক্ষা সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে জনভিত্তিক রূপ দিতে উদ্যোগী হন।
এই পদক্ষেপগুলো রাষ্ট্রীয় অন্তর্ভুক্তির ধারণাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়।

বিএনপি ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ: বাস্তব প্রয়োগ
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত হয়, যার মূলমন্ত্র ছিল “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, ইসলামিক মূল্যবোধ, গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক ন্যায়।”
১৯৭৯ সালের নির্বাচনে জনগণের বিপুল সমর্থন পেয়ে বিএনপি বহুদলীয় রাজনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়।
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দলটি রাষ্ট্র পরিচালনার ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। বাজার অর্থনীতি, বেসরকারি বিনিয়োগ, রপ্তানি-বান্ধব শিল্পনীতি ও স্থানীয় সরকার সংস্কারের মাধ্যমে বিএনপি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক নতুন ধারা প্রবর্তন করে।
তবে সমালোচকরা বলেন, প্রশাসনিক স্বচ্ছতার অভাব, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার সংঘাত, ও অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের ঘাটতি দলটির অগ্রযাত্রাকে বারবার বাধাগ্রস্ত করেছে।

আদর্শের পুনঃপ্রাসঙ্গিকতা: একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ
২০২৫ সালের বাস্তবতায় বাংলাদেশ আবারও গণতান্ত্রিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে —
🔹 নির্বাচনী নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতার প্রশ্ন,
🔹 প্রশাসনিক জবাবদিহিতার অভাব,
🔹 নাগরিক স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের সীমাবদ্ধতা,
🔹 এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের গভীরতা।
এই প্রেক্ষাপটে “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ” পুনরায় আলোচনায় এসেছে।
বিএনপি এখন একে নতুন অর্থে পুনর্নির্মাণ করছে — একটি inclusive, democratic, and justice-oriented nationalism, যেখানে জাতির ঐক্য, ধর্মীয় সহাবস্থান এবং অর্থনৈতিক ন্যায় একে অপরের পরিপূরক।

বিএনপির আগামীর রাষ্ট্র ভাবনা
বিএনপি যে নতুন রাষ্ট্রদর্শন প্রস্তাব করছে, তা ৭ নভেম্বরের চেতনারই আধুনিক সম্প্রসারণ।
রাজনৈতিক কাঠামোতে:
নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন
সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমে ক্ষমতার ভারসাম্য
অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাচন সরকার ব্যবস্থা
অর্থনৈতিক নীতিতে:
উৎপাদননির্ভর ও রপ্তানিমুখী অর্থনীতি
বেকারত্ব হ্রাসে দক্ষতা উন্নয়ন
সবুজ ও ডিজিটাল অর্থনীতির সমন্বয়
সামাজিক কাঠামোতে:
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা
মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা
সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক কাঠামোতে:
ইসলামিক মূল্যবোধ ও দেশীয় সংস্কৃতির সমন্বয়
সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার সুরক্ষা
মুক্তিযুদ্ধের বহুমাত্রিক ইতিহাস পুনঃপ্রতিষ্ঠা
এই পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত হলে “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ” একবিংশ শতাব্দীর জন্য একটি কার্যকর ও আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় রূপ নিতে পারে।

বিশ্লেষণ
রাজনৈতিক তত্ত্ববিদদের অনেকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে “inclusive conservatism” বলে অভিহিত করেছেন — এমন এক জাতীয়তাবাদ যা ধর্ম, সংস্কৃতি ও আধুনিকতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখে।
এই দর্শনের শক্তি হলো, এটি নাগরিকদের অন্তর্ভুক্ত করে, বিভাজন নয়; ঐক্য সৃষ্টি করে।
তবে এই দর্শন কার্যকর করতে হলে দরকার হবে —
১.দলীয় কাঠামোতে গণতন্ত্রের অনুশীলন,
২.বিচার ও প্রশাসনে নিরপেক্ষতা,
৩. এবং সমাজে সহনশীলতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা।

শেষ কথা:
৭ নভেম্বর শুধু ইতিহাসের একটি তারিখ নয় — এটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রচিন্তার পুনর্জন্মের দিন।
এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, রাষ্ট্র মানে ক্ষমতার কেন্দ্র নয়, বরং জনগণের অংশগ্রহণে গঠিত ন্যায়ভিত্তিক সমাজ।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ সেই চেতনারই আধুনিক রূপ, যা জাতিকে বিভাজন থেকে ঐক্যের পথে, কর্তৃত্ব থেকে গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে নেয়।
বিএনপি যদি এই আদর্শকে আধুনিক প্রেক্ষাপটে মানবিক, প্রযুক্তিনির্ভর ও ন্যায়নিষ্ঠ রূপে রূপান্তর করতে পারে, তবে এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে পুনর্জাগ্রত করতে সক্ষম হবে।
৭ নভেম্বর তাই কেবল অতীত নয় — এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রচিন্তার দিকনির্দেশনা।

— মোহাম্মদ এহছানুল হক ভূঁইয়া
প্রধান সম্পাদক, ধানের শীষ ডট নেট
www.dhanershis.net

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো সংবাদ পড়ুন
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
প্রযুক্তি সহায়তায়: ইয়োলো হোস্ট