
মোহাম্মদ এহছানুল হক ভূঁইয়া
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনৈতিক ইতিহাস মূলত সাংবিধানিক বৈধতা, রাষ্ট্রক্ষমতার উৎস ও গণভোটের মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অর্জনের প্রশ্নকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। রাষ্ট্রক্ষমতার বৈধতা কেবল নির্বাচনের মাধ্যমে নয়, বরং সংবিধানের স্বীকৃত কাঠামো ও গণসম্মতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে একাধিকবার রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে সামরিক অভ্যুত্থান, বিপ্লব বা দলীয় একনায়কতন্ত্রের মাধ্যমে, যার ফলে সাংবিধানিক বৈধতা প্রায়ই বিতর্কিত রূপ নিয়েছে।
১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তন ও ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে ঐ ঘটনার দায়মুক্তি নিশ্চিত করেন। এ ব্যবস্থাটি ছিল একটি “অন্তর্বর্তী বৈধতার” প্রচেষ্টা, যেখানে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়া হয়। রাজনৈতিক বিজ্ঞানীদের ভাষায়, এটি “Rule by decree”-এর এক উদাহরণ, যা গণতান্ত্রিক কাঠামোর বাইরে ক্ষমতার বৈধতা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা নির্দেশ করে।
পঞ্চম সংশোধনী ও সাংবিধানিক বৈধতার কাঠামো
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল সংসদে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বিল উত্থাপিত হয়, যা ৯ এপ্রিল দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে গৃহীত হয়। এর মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৫ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক শাসনের সকল কার্যক্রমকে সাংবিধানিক বৈধতা প্রদান করা হয়।
এ পদক্ষেপটি “retrospective constitutionalization” বা অতীতের কর্মকাণ্ডকে আইনি মর্যাদা দেওয়ার একটি ধারা, যা অনেক রাষ্ট্রে সামরিক বা বিপ্লব-পরবর্তী বৈধতা অর্জনের প্রচলিত রূপ। জিয়াউর রহমানের উদ্যোগ মূলত রাষ্ট্রের ধারাবাহিকতা রক্ষার রাজনৈতিক প্রয়াস হলেও, এটি সংবিধানের মৌলিক নীতিমালা—জনগণের সার্বভৌমত্ব ও গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতার নীতির সঙ্গে সংঘর্ষ তৈরি করে।
গণভোট ও জনপ্রত্যয়ের প্রশ্ন
১৯৭৭ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিজের শাসনের গণসমর্থন যাচাইয়ের জন্য একটি গণভোটের আয়োজন করেন। যদিও সরকারিভাবে এই গণভোটে বিপুল সমর্থন দেখানো হয়, তবু গবেষক ও পর্যবেক্ষকরা এটিকে “controlled plebiscite” হিসেবে দেখেছেন। কারণ, গণভোটের মাধ্যমে প্রাপ্ত জনসমর্থন ছিল সামরিক শাসনের রাজনৈতিক বৈধতা নিশ্চিত করার একটি উপায়, প্রকৃত গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ নয়।
তবু এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ নজির—যেখানে গণভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বকে জনপ্রত্যয়ের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছিল।
৫ম সংশোধনীর বাতিল ও সাংবিধানিক বিপর্যয়
২০১০ সালে উচ্চ আদালতের রায়ের মাধ্যমে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করা হয়। আদালত বলেন, সামরিক শাসন ও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী। তবে এই রায় নতুন এক বিতর্কের জন্ম দেয়—রাষ্ট্রীয় বৈধতা কি শুধুমাত্র আদালতের মাধ্যমে নির্ধারিত হতে পারে, নাকি জনগণের অনুমোদনই চূড়ান্ত উৎস?
এই প্রশ্ন থেকেই উদ্ভূত হয় একটি মৌলিক রাজনৈতিক সংকট—বাংলাদেশের সংবিধানিক ধারাবাহিকতা বারবার আদালত, সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে টানাপোড়েনের শিকার হয়েছে।
সমকালীন প্রেক্ষাপট:জুলাই সনদ, অন্তর্বর্তী সরকার ও ভবিষ্যৎ বৈধতা
২০২৪ সালের জুলাই ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতা আবারও এক নতুন সংবিধানিক প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা প্রতিষ্ঠা ও “জুলাই সনদ”-এর ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে হলে সংসদীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক সাংবিধানিক বৈধতা প্রদান অপরিহার্য।
যদি এই অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ডকে সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত করা না হয়, তবে ভবিষ্যতে এই আন্দোলনের নেতৃত্বও ১৯৭৫ সালের বিপ্লবের নায়কদের মতোই ইতিহাসের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হতে পারে।
শেষাংশ:
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস প্রমাণ করে, কোনো সরকার বা আন্দোলন তখনই টিকে থাকে যখন তা সংবিধানিক বৈধতা ও জনগণের অংশগ্রহণে প্রতিষ্ঠিত হয়। গণভোট, সংশোধনী বা আদালতের রায়—সবই ক্ষমতার বৈধতা নিশ্চিত করার প্রক্রিয়া, কিন্তু এর প্রকৃত ভিত্তি হচ্ছে জনগণের সম্মিলিত ইচ্ছা।
অতএব, আগামী দিনের রাষ্ট্রব্যবস্থায় “জুলাই সনদ” ও অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমকে সাংবিধানিক সুরক্ষা না দিলে পুনরায় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে—যেখানে বৈধতা নির্ভর করবে শক্তির ওপর, জনগণের ওপর নয়।
— মোহাম্মদ এহছানুল হক ভূঁইয়া
প্রধান সম্পাদক, ধানের শীষ ডট নেট
www.dhanershis.net