
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে “জাতীয় ঐকমত্য কমিশন” এবং “অন্তর্বর্তী সরকার” বিষয় দুটি জাতির ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক রূপরেখা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তবে বিএনপি’র সাম্প্রতিক প্রতিক্রিয়া ইঙ্গিত দেয়— এই প্রক্রিয়া নিয়ে প্রধান রাজনৈতিক স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে আস্থাহীনতা এবং প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে জটিলতা তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক বিজ্ঞান দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি কেবল রাজনৈতিক মতবিরোধ নয়; এটি সংবিধানিক বৈধতা, ক্ষমতার ভারসাম্য এবং রাজনৈতিক ঐকমত্যের তাত্ত্বিক কাঠামোকে পুনরায় আলোচনায় এনেছে।
ঐকমত্য ও সংবিধান: তাত্ত্বিক কাঠামো
রাজনৈতিক দর্শনে “ঐকমত্য” (consensus) হলো রাষ্ট্রের নীতি, আইন ও শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণমূলক বৈধতা সৃষ্টির প্রক্রিয়া। জন রলসের Theory of Justice বা ইউর্গেন হাবারমাসের Deliberative Democracy তত্ত্বে বলা হয়েছে— রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণমূলক আলোচনার মাধ্যমে ন্যায্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করা হয়।
বাংলাদেশের “জুলাই সনদ” ছিল সেই অংশগ্রহণমূলক নীতির প্রতিফলন, যেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নাগরিক সংগঠন ও উপদেষ্টারা জাতীয় সংকট উত্তরণের পথ খুঁজতে একমত হয়েছিলেন। কিন্তু ঐকমত্যের এই কাঠামো যখন এক বা একাধিক রাজনৈতিক দলের মতামতের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তখন তা ঐকমত্য নয়, বরং আধিপত্যের রূপ নেয়— যা গণতন্ত্রের মূল চেতনাকে ব্যাহত করে।
বিএনপি’র অবস্থান ও রাজনৈতিক বাস্তবতা
বিএনপি মনে করে, “জাতীয় ঐকমত্য কমিশন” এবং “অন্তর্বর্তী সরকার” একই রাজনৈতিক অবস্থানে থেকে এমন এক প্রস্তাব তৈরি করেছে, যা কার্যত জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র মতামতকে প্রাধান্য দিয়েছে। দলটির অভিযোগ— বিএনপি’র “নোট অব ডিসেন্ট” উপেক্ষা করা হয়েছে এবং তাদের অংশগ্রহণমূলক মতামত চূড়ান্ত প্রতিবেদনে প্রতিফলিত হয়নি।
এই পরিস্থিতিকে বিএনপি শুধু রাজনৈতিক প্রতারণা হিসেবে নয়, বরং গণতান্ত্রিক সংলাপের ব্যর্থতা ও প্রতিনিধিত্বের সংকট হিসেবে চিহ্নিত করছে। রাজনৈতিক বিজ্ঞানের ভাষায়, এটি “inclusion–exclusion paradox”— যেখানে বৃহত্তর অংশগ্রহণের কথা বলা হলেও সিদ্ধান্তগ্রহণে বাস্তবে একটি সীমিত গোষ্ঠী প্রভাব বিস্তার করে।
ঐতিহাসিক সাদৃশ্য: ইয়াহিয়া ও আইয়ুবের শাসন কাঠামো
বিএনপি নেতারা কমিশনের প্রস্তাবের তুলনা করেছেন ইয়াহিয়া খানের “লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (LFO)” এবং আইয়ুব খানের “বেসিক ডেমোক্রেসি” ব্যবস্থার সঙ্গে। উভয় ক্ষেত্রেই জনগণের অংশগ্রহণকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপে সীমিত করে ক্ষমতার কেন্দ্রীয়ীকরণ ঘটানো হয়েছিল।
যদি গণভোটে পাস হওয়া প্রস্তাবগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহলে সংবিধানিক ভারসাম্য (constitutional balance) ও বিধানিক জবাবদিহিতা (legislative accountability) মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ধরনের পদক্ষেপ “popular authoritarianism”-এর ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে— যেখানে গণতন্ত্রের নামে ক্ষমতার কেন্দ্রীয়ীকরণ ঘটে।
ক্ষমতার ভারসাম্য ও গণতান্ত্রিক বৈধতা
একটি অন্তর্বর্তী সরকারের মূল উদ্দেশ্য হলো নির্বাচনকালীন রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা ও প্রশাসনিক ভারসাম্য নিশ্চিত করা। কিন্তু যখন ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ বা সরকারের কাঠামো একপক্ষীয় ধারণায় প্রভাবিত হয়, তখন power equilibrium বা ক্ষমতার ভারসাম্য ভেঙে পড়ে।
রাজনৈতিক বিজ্ঞানীরা বলেন, কার্যকর গণতন্ত্র টিকে থাকে তিনটি স্তম্ভের ভারসাম্যে—
১. রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি (political inclusion)
২. সংবিধানিক নিরপেক্ষতা (constitutional neutrality)
৩. প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা (institutional transparency)
বিএনপি’র অভিযোগ অনুযায়ী, এই তিন ক্ষেত্রেই বর্তমান প্রক্রিয়ায় ঘাটতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
ঐকমত্যের সংকট ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ
জুলাই সনদ ছিল জাতীয় ঐক্যের এক প্রতীকী পদক্ষেপ, কিন্তু এর বাস্তবায়নে উদ্ভূত মতবিরোধ এখন গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাব যদি এক বা একাধিক দলের মতামতের প্রতিফলন হয়ে দাঁড়ায়, তবে তা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করবে।
এটি “consensual legitimacy”-এর পরিবর্তে “imposed legitimacy”— অর্থাৎ জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে নয়, বরং উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া বৈধতা। দীর্ঘমেয়াদে এটি সংবিধানিক আস্থার সংকট এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর জনগণের বিশ্বাস ক্ষুণ্ণ করতে পারে।
শেষ কথা
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ এবং অন্তর্বর্তী সরকারের কাঠামোকে ঘিরে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব— অংশগ্রহণ বনাম আধিপত্য, ঐকমত্য বনাম প্রতিদ্বন্দ্বিতা—কে নতুন করে উন্মোচন করেছে।
সংবিধানিক ঐক্য ও রাজনৈতিক ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত সংলাপমুখী রাজনীতি, যেখানে প্রতিটি দল ও নাগরিক অংশীদার নিজেদের মতামত স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে পারে। অন্যথায় ঐকমত্যের নামে যে প্রক্রিয়া চলছে, তা গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক করার পরিবর্তে আরও বেশি অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
— মোহাম্মদ এহছানুল হক ভূঁইয়া
প্রধান সম্পাদক, ধানের শীষ ডট নেট
www.dhanershis.net