প্রতি বছর ১৫ই আগস্টে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন চলে, সেটি প্রথম নজরে দেশপ্রেমের প্রকাশ মনে হলেও, এর পেছনে একটি সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক ক্যাম্পেইন কাজ করে। অধিকাংশ পোস্ট ছিল আওয়ামী লীগের দীর্ঘমেয়াদি সহযোগী, সুবিধাভোগী এবং সাংস্কৃতিক এলিটদের—যারা চায় আওয়ামী লীগ ফের ক্ষমতায় আসুক, যেন তাদের বিশেষ সুবিধা, দুর্নীতি ও প্রভাব অব্যাহত থাকে।
গড়ে তোলা ন্যারেটিভ
এই প্রচারণার মূল কৌশল ছিল শেখ মুজিবকে আলাদা করে গৌরবান্বিত করা, কিন্তু তার শাসনামলের অন্ধকার দিকগুলো এড়িয়ে যাওয়া।
কোথাও উল্লেখ নেই রক্ষীবাহিনীর দমননীতি,
নেই ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ,
নেই একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের কথা।
অর্থাৎ, মুজিবকে ভালোবাসলেও আওয়ামী লীগের অপকর্ম বা গত ১৬ বছরের হত্যাযজ্ঞের নিন্দা কেউ করেনি।
মুজিব আমলের অন্ধকার অধ্যায়
১৯৭২–৭৫ সালের শাসনকাল মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নকে গণতন্ত্রের পথে না নিয়ে গিয়ে স্বৈরতন্ত্রের দিকে ঠেলে দিয়েছিল।
রক্ষীবাহিনী গঠন: বিরোধী ও ভিন্নমতাবলম্বীদের অপহরণ, গুম, নির্যাতন ও হত্যা। গবেষকদের মতে, হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছিলেন, যাদের মধ্যে অনেক মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন।
১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ: প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ মারা যান। আন্তর্জাতিক গবেষক Lawrence Lifschultz ও Anthony Mascarenhas এটিকে সরকারের অদক্ষতা ও দুর্নীতির ফল বলে উল্লেখ করেছেন।
বাকশাল ও একদলীয় শাসন: গণতন্ত্রের পরিবর্তে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা।
এসব কারণে জনরোষ তৈরি হয়েছিল, যা ১৯৭৫ সালের ঘটনাকে ত্বরান্বিত করে।
১৫ই আগস্ট হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট
শেখ মুজিবকে হত্যাকারীদের অধিকাংশই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। যদিও হত্যাকাণ্ডটি ছিল নিন্দনীয়, কিন্তু এর পেছনে জমে থাকা ক্ষোভ, রক্ষীবাহিনীর হত্যা-দমন ও দুর্ভিক্ষের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। প্রধান হত্যাকারীরা যেমন সৈয়দ ফারুক রহমান, খন্দকার আবদুর রশীদ, শরিফুল হক ডালিম, নূর চৌধুরী—তারা সকলেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।
প্রোপাগান্ডার কৌশল: সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ
গোয়েন্দা সূত্র অনুযায়ী ১৪ আগস্ট আওয়ামী লীগপন্থী কয়েকজন শীর্ষ নেতা ও প্রভাবশালী মিডিয়া ব্যক্তিত্বের বৈঠক হয়। এরপর শুরু হয় সমন্বিত প্রচারণা:
১. প্রথম ধাপ: ঘনিষ্ঠ কয়েকজন শিল্পীর শোকবার্তা পোস্ট।
২. দ্বিতীয় ধাপ: বাংলা সিনেমার এক শীর্ষ নায়কের পোস্টকে “ভ্যালিডেশন” হিসেবে ব্যবহার।
৩. তৃতীয় ধাপ: গণমাধ্যমে গ্লোরিফিকেশন ও বিশেষ ফিচার।
৪. চতুর্থ ধাপ: ফেসবুকে হাজার হাজার বট অ্যাকাউন্ট দিয়ে লাইক-কমেন্ট-শেয়ার বন্যা।
এটি আসলে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের (psychological warfare) অংশ—যেখানে মানুষের মনে বিভ্রান্তি, ভয় ও কৃত্রিম নস্টালজিয়া তৈরি করা হয়।
বিরোধী শক্তির দুর্বলতা
একই সময়ে বিএনপি, জামায়াত কিংবা ছাত্রদল আওয়ামী লীগের দীর্ঘমেয়াদি দমননীতি, নির্বাচন জালিয়াতি বা জুলাইয়ের গণহত্যা নিয়ে কার্যকর প্রচারণা চালাতে ব্যর্থ হয়েছে। বরং তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে আক্রমণেই বেশি সময় ব্যয় করছে। ফলে আওয়ামী লীগের তৈরি ন্যারেটিভই প্রাধান্য পাচ্ছে।
করণীয় কী?
বাংলাদেশ এখন শুধু রাজনৈতিক নয়, এক মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছে।
আমাদেরকে ইতিহাসের বিকৃতি প্রতিরোধ করতে হবে।
সাংস্কৃতিক প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।
যারা জুলাই হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছে, তাদের বিচারের দাবি অটুট রাখতে হবে।
আজকের শপথ হোক: ষড়যন্ত্র ও প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থেকে সত্যিকারের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষা করা।
মোহাম্মদ এহছানুল হক ভূঁইয়া
প্রধান সম্পাদক, ধানেরশীষ ডট নেট
www.dhanershis.net