বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে—যারা অতি আত্মবিশ্বাসে ভুগে নিজেদের অপ্রতিরোধ্য ভেবেছে, সময় তাদের প্রকৃত অবস্থান চিহ্নিত করে দিয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নামে নতুন এই রাজনৈতিক শক্তি যখন “নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত” এর ঘোষণা দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে, তখন তাদের পথচলা কতটা টেকসই হবে তা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠেছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর গঠিত এই দলটি কি আদৌ পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে বের হতে পেরেছে, নাকি নতুন মোড়কে পুরনো ওয়াইন পরিবেশন করছে—এটি একটি গভীর বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
এনসিপির উত্থান ও ঘোষণা: নতুন দিনের প্রতিশ্রুতি
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে। দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ঘোষণা করেছিলেন, “জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ৫৪ বছর পর দেশের মানুষের সামনে নতুন বিকল্প রাজনৈতিক শক্তিকে খুঁজে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজদের দিয়ে আমরা আর পুরনো রাজনৈতিক খেলা খেলতে চাই না” । তাদের মূল বার্তা ছিল দুর্নীতি, মাফিয়া সংস্কৃতি এবং পুরনো রাজনৈতিক ধারার বিরুদ্ধে একটি র্যাডিক্যাল পরিবর্তন আনা।
প্রাথমিকভাবে এনসিপি বেশ কিছু আকর্ষণীয় নীতি প্রস্তাব করেছিল:
– বিচার ব্যবস্থার আমূল সংস্কার
– আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচন
– জুলাই সনদের ভিত্তিতে মৌলিক সংস্কার
– “গণতান্ত্রিক, সমতাভিত্তিক ও জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী” রাজনৈতিক কাঠামো
দলটি দাবি করেছিল তারা “রাজনীতিবিমুখ” শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের মধ্যে নতুন আশার জন্ম দিয়েছে । তাদের টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ভ্রমণকে “বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পুনর্গঠনে একটি নতুন রাজনীতির সূচনা” হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল ।
বাস্তবতার মুখোমুখি: আদর্শ ও কর্মকাণ্ডের পার্থক্য
যাইহোক, মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে এনসিপির কর্মকাণ্ড তাদের আদর্শিক অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে শুরু করে। দলটির নেতাদের বেশ কয়েকটি বিতর্কিত কর্মকাণ্ড জনমনে প্রশ্ন সৃষ্টি করেছে:
১. বিলাসবহুল জীবনযাপন:
গত রমজানে রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেলে জাঁকজমকপূর্ণ ইফতার পার্টির আয়োজন করে এনসিপি। একটি নতুন রাজনৈতিক দল এই বিলাসবহুল ইফতার আয়োজনের টাকা কোথায় পেল, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে । দলটির বাংলামোটরের কার্যালয়ের ব্যয়ভার নিয়েও সমালোচনা তৈরি হয় ।
২. নেতাদের শক্তি প্রদর্শন:
এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম শতাধিক গাড়ির বহর নিয়ে পঞ্চগড়ে নিজ এলাকায় শোডাউন করে সমালোচনার মুখে পড়েন । এই ঘটনাটি দলের অভ্যন্তরেই বিতর্ক সৃষ্টি করে, যেখানে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা ফেসবুকে এর সমালোচনা করেন ।
৩. অভ্যন্তরীণ কোন্দল:
এনসিপি নেতারা বারবার ফেসবুকে একে অপরের বিরুদ্ধে পোস্ট-পাল্টা পোস্ট দিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছেন । বিএনপির এক জ্যেষ্ঠ নেতার করা মন্তব্য ঘিরে সারজিস বিদ্রূপ করে ফেসবুকে একাধিক পোস্ট দিয়েছেন ।
৪. দুর্নীতির অভিযোগ:
পাঠ্যবই ছাপানোর কাজে দুর্নীতি-অনিয়ম এবং জেলা প্রশাসক নিয়োগে অবৈধভাবে হস্তক্ষেপের অভিযোগে এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরকে দল থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেয়া হয় । সাবেক এনসিপি নেতা গাজী সালাউদ্দিন তানভীরের বিরুদ্ধে তদবির বাণিজ্যসহ কিছু অভিযোগ উঠেছিল ।
৫. নেতৃত্বের দূরত্ব:
এনসিপি প্রধান নাহিদ ইসলামের কার্যক্রম নিয়েও সমালোচনা রয়েছে। প্রেস কনফারেন্স আর ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া ছাড়া সাধারণ জনমানুষের সঙ্গে সরাসরি তার সংযোগ কতটা হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে ।
“পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতির উপাদান আমাদের ভেতরও আসার চেষ্টা করছে। আমরা সেটাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনছি” – নাহিদ ইসলাম
এই উক্তিটি স্ববিরোধী মনে হয় যখন দেখা যায় যে দলটি নিজেই পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতির পুনরাবৃত্তি করছে।
সংগঠনগত দুর্বলতা ও আদর্শিক অস্পষ্টতা
এনসিপির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো তাদের আদর্শিক অবস্থানের অস্পষ্টতা এবং সংগঠনগত দুর্বলতা:
১. মধ্যপন্থার দাবি বনাম বাস্তবতা:
এনসিপি নিজেদের মধ্যপন্থার দল হিসেবে দাবি করলেও বিভিন্ন ইস্যুতে দলীয় নেতাদের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান জনমনে দ্বিধা তৈরি করেছে । উদাহরণস্বরূপ, হেফাজতের একটি সমাবেশে নারীদের নিয়ে ‘বিতর্কিত’ মন্তব্য করা হলে, তা নিয়ে হেফাজতকে আইনি নোটিশ প্রদানকারী ছয় নারীর তিনজনই এনসিপির। অথচ ওই সমাবেশে এনসিপির দুই নেতাও উপস্থিত ছিলেন ।
২. গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব:
দলটি গণতান্ত্রিক চর্চার কথা বললেও অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সভায় শীর্ষ নেতাদের বিলাসী জীবনযাপন, বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, কিন্তু সেগুলোর সন্তোষজনক সমাধান দেখা যায়নি ।
৩. তৃণমূল সংযোগের অভাব:
“টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া” ভ্রমণের কথা বলা হলেও দলটির তৃণমূল পর্যায়ে প্রকৃত সংগঠন গড়ে তোলার সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ আছে। দলের নেতৃত্ব প্রধানত রাজধানীকেন্দ্রিক এবং সামাজিক মাধ্যমনির্ভর ।
৪. আর্থিক স্বচ্ছতার অভাব:
দলটির ব্যয়বহুল আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান, রাজধানীর একটি আধুনিক ভবনে জাঁকজমকপূর্ণ কেন্দ্রীয় কার্যালয়—এসব বিপুল খরচের অর্থের উৎস কী তা স্পষ্ট নয় । বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম নিজে জানিয়েছেন তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মাত্র ১০ হাজার ৬৯৮ টাকা আছে ।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
‘কিংস পার্টি’র অভিযোগ ও এর তাৎপর্য
এনসিপিকে অনেক বিশ্লেষক ‘কিংস পার্টি’ (রাজার দল) হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, যা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গঠিত হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে । বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করেছেন, “আগামী সংসদে কারা নির্বাচিত হবে, রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যদি তা নির্ধারণ করে দেয়, তাহলে জুলাই আত্মত্যাগের কী দাম থাকবে?” ।
ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, বাংলাদেশে রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে গঠিত দলগুলোর (যেমন জাগদল, জাতীয় পার্টি, বিএনএম) বেশিরভাগই টেকসই হতে পারেনি । এনসিপি কি এই ধারার ব্যতিক্রম হবে, নাকি ইতিহাস নিজেকে পুনরাবৃত্তি করবে—এটি দেখার বিষয়।
দলটির নেতারা অবশ্য এই অভিযোগ নাকচ করে বিএনপিকেই সফল ‘কিংস পার্টি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন । জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মুহাম্মদ নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বিএনপিকে ‘কিংস পার্টি’ বলে আখ্যা দেন ।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
এনসিপির সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা রয়েছে:
১. নির্বাচনী কৌশল:
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এনসিপি একা নির্বাচন করলে সবার জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে । এনসিপিরই এক নেতা সারজিস আলম বলেছেন, “তারা যে নতুন বন্দোবস্তের কল্পনা করেন, সেটা ছয় মাসের মধ্যে প্রয়োগ করলে নির্বাচনে ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই জামানত হারানোর আশঙ্কা থাকবে” । তাই বিএনপির সঙ্গে কোনো ধরনের জোট বা সমঝোতা তাদের জন্য উপকারী হতে পারে ।
২. জনসমর্থন:
এনসিপি কি দেশের সবচেয়ে বড় দল বিএনপি কিংবা জামায়াতে ইসলামীর মতো দলগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো পর্যাপ্ত সমর্থন জোগাড় করতে পারবে? প্রবীণরা কী ভাবছেন? তারা কি বিচ্ছিন্ন নাকি এরমধ্যেই তারা কোনো দলকে বেছে নিয়েছে? —এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
৩. তরুণদের আকর্ষণ:
এনসিপির এক বড় শক্তি হলো তরুণদের সমর্থন। শহর ও গ্রামগুলোর মধ্য দিয়ে এনসিপির বহর যতই এগোচ্ছে ততই স্পষ্ট হচ্ছে যে এই অভিযানের নেতৃত্বে আছেন তরুণরা। ছেলে-মেয়ে উভয়ই, হাজারে হাজারে তারা রয়েছে । এই শক্তিকে কাজে লাগাতে পারলে দলটি একটি বড় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।
৪. আন্তর্জাতিক মনোযোগ:
প্রেস সচিব শফিকুল আলমের মতে, “এই তরুণ নেতারা যখন জাতির পথচলা পুনর্নির্ধারণের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন তখন পুরো বিশ্বের নজর রয়েছে তাদের ওপর” । এই আন্তর্জাতিক মনোযোগ ইতিবাচকভাবে কাজে লাগানো যায় কিনা তা দেখার বিষয়।
৫. সংস্কার এজেন্ডা:
এনসিপি যদি জুলাই সনদের ভিত্তিতে মৌলিক সংস্কারের এজেন্ডাকে সামনে নিয়ে আসে এবং তা বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখে, তাহলে তারা একটি আলাদা অবস্থান তৈরি করতে পারে। নাহিদ ইসলাম বলেছেন, “আমাদের লক্ষ্য হলো দুর্নীতিবাজ, মাফিয়া কৃষ্টির পরিবর্তন। এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে জরুরি বিষয় বিচারব্যবস্থার সংস্কার” ।
উপসংহার: ইতিহাসের পাঠ ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে যে, নতুন নতুন দলের আবির্ভাব ঘটলেও সেগুলো টেকসই হতে গেলে কয়েকটি শর্ত পূরণ করতে হয়: সুস্পষ্ট আদর্শিক ভিত্তি, তৃণমূল সংগঠন, নেতৃত্বের সততা ও দূরদর্শিতা, এবং জনগণের সঙ্গে প্রকৃত সংযোগ। এনসিপি এখনো এই শর্তগুলো পূরণ করতে পারেনি বলেই মনে হয়।
“রাজনীতি শুধু স্লোগান না, এটা ধৈর্য, আত্মত্যাগ আর ইতিহাসের সঙ্গে চলার নাম। বেশি চুলকালে যে কী হয়, সেটা সময় খুব ভালো বুঝিয়ে দেয়।”
এই বাক্যটি এনসিপির জন্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। দলটি যদি তাদের আদর্শিক অবস্থান থেকে সরে আসে, অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে, এবং জনগণের থেকে দূরত্ব তৈরি করে, তাহলে তারা খুব দ্রুতই প্রাসঙ্গিকতা হারাবে। অন্যদিকে, যদি তারা প্রকৃতপক্ষে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার চেষ্টা করে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং জনগণের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ বাড়ায়, তাহলে তারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।
ইতিহাস সাক্ষী, বাংলাদেশে অনেক নতুন দল এসেছে, কিন্তু খুব কমই টিকে থাকতে পেরেছে। এনসিপি কি সেই স্বল্পসংখ্যক দলের একটি হবে, নাকি ইতিহাসের পাতায় আরেকটি পাদটীকা হিসেবে থেকে যাবে—তা নির্ভর করছে তাদের বর্তমান কর্মকাণ্ড ও ভবিষ্যৎ কৌশলের উপর। সময়ই এর চূড়ান্ত উত্তর দেবে।
লেখক :
মোঃ এহসানুল হক ভূঁইয়া
প্রধান সম্পাদক , ধানের শীষ ডট নেট।
www.dhanershis.net