সংঘাতের বর্তমান অবস্থা
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত এখন ষষ্ঠ দিনে প্রবেশ করেছে এবং দিন দিন তা আরও তীব্র ও জটিল আকার ধারণ করছে। গত ১৮ জুন পর্যন্ত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী:
ইরানের হামলা:
ইরান তাদের হাইপারসনিক “ফাত্তাহ-১” ক্ষেপণাস্ত্রসহ বিভিন্ন মিসাইল দিয়ে ইসরায়েলের তেল আবিব, হাইফা, জেরুজালেমসহ গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েলি সূত্রমতে, ইরান ইসরায়েল অভিমুখে ৩০টিরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে ।
ইসরায়েলের পাল্টা হামলা:
ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ও অস্ত্র কারখানাগুলো লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালিয়েছে। বিশেষ করে তেহরানের নিউক্লিয়ার রিসার্চ সেন্টার ও কারাজের সেন্ট্রিফিউজ উৎপাদন কেন্দ্রে হামলা চালানো হয়েছে ।
ক্ষয়ক্ষতি:
ইরানের হামলায় ইসরায়েলে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ২৪ জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছে। অন্যদিকে, ইরানে নিহতের সংখ্যা ৫৮৫ জন ছাড়িয়েছে, যার মধ্যে ২৩৯ জন সাধারণ নাগরিক ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ও কৌশল:
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এই সংঘাতে সবচেয়ে জটিল ও পরিবর্তনশীল বিষয়:
প্রাথমিক অনীহা:
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রথমদিকে সংঘাত থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে ৩৯টি যুদ্ধবিমান ইউরোপে সরিয়ে নিয়েছিলেন ।
হুমকি ও আল্টিমেটাম:
ট্রাম্প ইরানকে “নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ” করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনিকে “সহজ লক্ষ্য” বলে উল্লেখ করেছেন ।
সামরিক প্রস্তুতি:
ইউএসএস নিমিটজ বিমানবাহী রণতরী মধ্যপ্রাচ্যের দিকে যাচ্ছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ফোর্ডো পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার জন্য বাংকার ভেদক বোমা ব্যবহারের সম্ভাবনা বিবেচনা করছে ।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া:
রাশিয়া:
প্রেসিডেন্ট পুতিন সংঘাত নিরসনে মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন। রাশিয়া ইসরায়েলকে মার্কিন সহায়তা না দেওয়ার জন্য সতর্ক করেছে ।
চীন:
চীন “গভীর উদ্বেগ” প্রকাশ করে সংঘাত “নিয়ন্ত্রণের বাইরে” চলে যাওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে ।
ইইউ:
ইউরোপীয় ইউনিয়ন উভয় পক্ষকে সংযত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে এবং বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষায় আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার তাগিদ দিয়েছে ।
অর্থনৈতিক প্রভাব:
সংঘাতের ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রভাব:
তেলের দাম:
প্রতি ব্যারেল তেলের দাম ইতিমধ্যেই ৭৫ ডলারে পৌঁছেছে (৭% বৃদ্ধি)। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে দাম ১২০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে ।
বাংলাদেশের উপর প্রভাব:
বাংলাদেশ তার জ্বালানি তেল আমদানির ২০-৩০% হরমুজ প্রণালি দিয়ে করে থাকে। সরকার ইতিমধ্যেই বিকল্প উৎস খোঁজার প্রস্তুতি নিচ্ছে ।
সামরিক কৌশল ও প্রযুক্তিগত দিক
ইরানের হাইপারসনিক মিসাইল:
ইরানের “ফাত্তাহ-১” হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র শব্দের গতির চেয়ে পাঁচগুণ বেশি বেগে চলতে পারে এবং মিডফ্লাইটে ম্যানুভার করতে সক্ষম, যা এগুলিকে ইন্টারসেপ্ট করা কঠিন করে তোলে ।
ইসরায়েলের লক্ষ্য:
ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে ব্যাহত করতে চাইছে, বিশেষ করে নাতানজ ও ফোর্ডোয়ের সেন্ট্রিফিউজ সুবিধাগুলো ধ্বংস করতে চেষ্টা করছে ।
মানবিক সংকট:
উভয় দেশে বেসামরিক নাগরিকদের দুর্ভোগ:
তেহরানের প্রায় ১ কোটি বাসিন্দার মধ্যে অনেকেই শহর ছেড়ে পালাচ্ছেন, যানজটে রাস্তা অচল হয়ে পড়েছে ।
আন্তর্জাতিক নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়া:
চীন ইতিমধ্যেই ৭০০ নাগরিককে ইরান ও ইসরায়েল থেকে সরিয়ে নিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও তার নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে ।
ভবিষ্যত সম্ভাবনা:
এই সংঘাতের সবচেয়ে খারাপ সম্ভাব্য পরিণতিগুলো হতে পারে :
১) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি জড়িয়ে পড়া:
যা অঞ্চলব্যাপী একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের সূত্রপাত করতে পারে।
২) উপসাগরীয় দেশগুলোর সম্পৃক্ততা:
বিশেষ করে যদি ইরান সৌদি আরব বা সংযুক্ত আরব আমিরাতের তেল স্থাপনাগুলোতে হামলা চালায়।
৩) ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র ত্বরান্বিত করা:
ইসরায়েলি হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরান পারমাণবিক অস্ত্র ের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।
৪) বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা:
তেলের দাম বৃদ্ধি ও সরবরাহ বিঘ্নিত হলে বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে পারে।
৫) ইরানে শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন:
ইসরায়েল ইরানের শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনকে লক্ষ্য হিসেবে উল্লেখ করেছে, যা দেশটিতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে।
সর্বশেষ:
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। উভয় পক্ষই এখন পর্যন্ত কঠোর অবস্থান বজায় রেখেছে এবং সংঘাত আরও বিস্তৃত হওয়ার আশঙ্কা ক্রমশ বাড়ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তৎপরতা সত্ত্বেও সংঘাত নিরসনের কোনও স্পষ্ট পথ এখনও দৃশ্যমান নয়। এই সংকটের সমাধান খুঁজে পেতে বিশ্ব নেতৃত্বের জরুরি ও সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন।
লেখক : মোহাম্মদ এহসানুল হক ভূঁইয়া, রাজনৈতিব বিশ্লেষক ও প্রধান সম্পাদক, ধানের শীষ ডট নেট