অপরাধ প্রতিবেদক : ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার বড়াইল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বড়াইল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ জাকির হোসেন জাকিরের কূটচালে বড়াইলের হিন্দুপাড়া দিনে দিনে মুসলিমপাড়ায় পরিনত হচ্ছে। এ নিয়ে বড়াইলে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। যে কোন সময় এলাকায় দাঙ্গা হাঙ্গামার সৃষ্টি হতে পারে বলে এলাকাবাসী আশঙ্কা করছে। স্বাধীনতার পর বড়াইলে বসবাসকারী সনাতনধর্মী হিন্দু গ্রামবাসী বিভিন্ন কারনে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। হিন্দুদের সে সম্পত্তি ছলেবলে কৌশলে মুসলিমদের দিয়ে রেখে দিচ্ছেন জাকির চেয়ারম্যান। কোন হিন্দু গ্রামবাসী হিন্দুদের সেই সম্পত্তি কিনতে চাইলে তাতে বাগড়া বসাচ্ছেন আওয়ামী লীগের সময় ইভিএমে নির্বাচিত এই চেয়ারম্যান। ইতিপূর্বে হিন্দুদের কিছু সম্পত্তি চেয়ারম্যানের যোগসাজসে কিনে নেন কয়েকজন মুসলিম গ্রামবাসী। জাকির চেয়ারম্যানের ভিলেজ পলিটিক্সের কারনে হিন্দুদের সম্পত্তি হিন্দুরা কিনতে চাইলেও সেটা তারা পারছেন না। বড়াইলের শহীদ পরিবারের সদস্য গোপাল চন্দ্র পাল কষ্ট নিয়েই বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বড় ভাই মারা যান। ১৯৭১ সালে হিন্দুবাড়ির ৯ জন সনাতনধর্মী হিন্দু গ্রামবাসীকে গুম করা হয়। স্বাধীনতার পর এ নিয়ে মামলাও করেছিল হিন্দুবাড়ির লোকজন। তবে রাজাকারদের অত্যাচারে সে মামলা চালাতে পারেননি বাদী। প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছাড়তে হয়। এ ঘটনার পর আমার পরিবার সহ বড়াইল হিন্দুবাড়ির অনেকেই ভারত চলে যান। আমাকেও যেতে বলেছিল। আমি যাইনি। কেন দেশ ছাড়বো? বাংলাদেশই আমার দেশ। এখানেই আমি থাকতে চাই পরিবারসহ। আমাদের বাড়িঘর মুসলমানদের কবরস্থানের জন্য দান করেছি। হিন্দুদের জমি মলাই মিয়া সরকার চেয়ারম্যানের আমলে বড়াইল বাজারের জন্য দিতে হয়েছে। এর বিনিময়ে কোন বদলা জমি পাইনি আমরা। এখন নিজের উপার্জিত টাকায় আমি জমি কিনছি।’
সম্প্রতি বড়াইল ইউনিয়ন পরিষদের গ্রামপুলিশ ও চৌকিদার গোপাল চন্দ্র পাল হিন্দুবাড়ির পুকুরপাড়ে বিজনের কাছ থেকে ১৬ শতক জমি কিনেন ১৫ লাখ টাকায়। জমির বায়না বাবদ ১২ লাখ টাকা বিজনকে পরিশোধ করেন গোপাল চন্দ্র পাল। অবশিষ্ঠ ৩ লাখ টাকা জমি রেজিষ্ট্রি করার দিন দেয়ার কথা। বায়নার টাকা পরিশোধের পর সে জমি রেজিস্ট্রি বা দলিল করে দিতে গড়িমসি শুরু করেন বিজন। তিনি জানান, জাকির চেয়ারম্যানের কথার বাইরে এখন তিনি জমি রেজিস্ট্রি করে দিতে পারবেন না। চেয়ারম্যানের সঙ্গে গোপাল সহ এলাকাবাসী যোগাযোগ করলে তিনি জানতে চান জমি বিক্রির বিষয়ে কোন কাগজপত্র করা হয়েছে কি না। এছাড়াও বিভিন্ন অবান্তর কথা বলে তিনি গ্রামে গোপালকে হয়রানী করতে থাকেন। একটি সূত্র জানায়, বড়াইলের সৌদী আরব ফেরত এক মুসলিম প্রবাসী গ্রামবাসীর কাছে হিন্দুদের জমিটি বেশি দামে বিক্রির চেষ্টা করছেন চেয়ারম্যান। সেই প্রবাসী ইতিপূর্বে বড়াইলের হিন্দুবাড়ির হিন্দুদের একটি পুকুর কিনে সেটি ভরাট করে নিজের নামে মার্কেট তৈরী করেন। সে সময় পরিবেশ অধিদপ্তর পুকুর ভরাট করার জন্য নোটিশও পাঠায় সে মুসলিম গ্রামবাসীকে।
এবারও হিন্দুরা যেন জমিটি কিনতে না পারে সেজন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের এই ইউনিয়ন সভাপতি। এ নিয়ে গ্রামে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি হলে বড়াইল কেন্দ্রীয় ঈদগাহ কমিটির সাধারণ সম্পাদক, বড়াইল পশ্চিমপাড়া জামে মসজিদের সাধারণ সম্পাদক ও বড়াইল ইসলামিয়া সিরাজুল উলুম মাদরাসার সাধারণ সম্পাদক মোঃ নাছির উদ্দিন, সেলিম মীর প্রমূখকে নিয়ে জমির মালিক বিজনের সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দেখা করেন গোপাল চন্দ্র পাল। সে সময়ও বিজন জানান, জাকির চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা না বলে তিনি কিছু করতে পারবেন না। গ্রামবাসী এক মাসের মধ্যে জমিটি গোপাল চন্দ্র পালকে রেজিস্ট্রি করে দেয়ার আলটিমেটাম দেয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার বড়াইল ইউনিয়ন ও বড়াইল গ্রামের বড়াইল মৌজার নকশা(ম্যাপ) এর ১নং শিটের সি.এস ১১৪৭ নং দাগের ও বি.এস ৬১১ নং দাগের ৪৯ শতক সরকারী ১নং খাস খতিয়ানভুক্ত জমিটি অবৈধভাবে দখল করে বড়াইলের আয়নাঘর বা টরচার সেল বানান জাকির চেয়ারম্যান। বড়াইল বাজারের উত্তরে হিন্দুবাড়ির কাছে চেয়ারম্যানের এই বিল্ডিং। ১৯৭১ সালের ২৪ শে এপ্রিল তৎকালীন ইউপি প্রেসিডেন্টের ইন্ধনে হিন্দুবাড়ির ৯ জন হিন্দু গ্রামবাসীকে গুম ও হত্যা করেন চেয়ারম্যানের বাপ-চাচা সহ স্থানীয় রাজাকার ও পাকিস্তানীরা। সে ঘটনার পুরস্কার হিসেবে মুসলিম লীগ নেতা ও তৎকালীন সাদেকপুর ইউনিয়ন পরিষদ প্রেসিডেন্ট (পরবর্তিতে বড়াইল ইউনিয়ন পরিষদ) হিন্দুদের সে জমিতে চেয়ারম্যানের বাপ-চাচাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেন। সে জমির দখলদারী বজায় রেখে বড়াইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর জাকির চেয়ারম্যান সরকারী ১ নং খতিয়ানের খাস জমিও দখল করে নেন। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী দুঃশ্বাসনের সময় ইভিএম নির্বাচনের মাধ্যমে জাকির চেয়ারম্যান টানা ২ বার বড়াইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হন। চেয়ারম্যান হওয়ার পরই তিনি ঘোষণা দেন বড়াইলে হিন্দুপাড়া বলে কিছু থাকবে না।তিনি “মুসলিম পাড়া” নামে “হিন্দুপাড়া”কে পরিচিত করতে শুরু করেন। চেয়ারম্যানের নির্যাতনে অতিষ্ট হয়ে অনেকেই এলাকা ছাড়েন। অনেকে কমদামে বাড়িঘরের জমি বিক্রি করতে বাধ্য হন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে চেয়ারম্যানের বাপ-চাচা কর্তৃক হিন্দুদের গুম, অত্যাচার করা সহ জাকির চেয়ারম্যানের বিভিন্ন অনৈতিক কার্যাবলী ও অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ও সোচ্চার হওয়ায় গ্রামপুলিশ গোপাল চন্দ্র পালকে বিভিন্ন সময় হয়রানী করেন এই আওয়ামী লীগ নেতা। এখন হিন্দুদের কাছ থেকে জমি কেনার ক্ষেত্রেও তিনি গোপালকে হয়রানী করছেন। চেয়ারম্যানের কূটচালে হিন্দুদের জমি হিন্দুরা কিনতে না পারায় বড়াইল গ্রামের হিন্দুপাড়া পাল্টে গিয়ে দিনে দিনে মুসলিমপাড়ায় পরিনত হচ্ছে।
এ বিষয়ে মোঃ নাছির উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে উনি বলেন, ‘গোপাল চন্দ্র পাল সনাতন ধর্মী হিন্দুু হলেও আমরা গ্রামের মুসলিমরা ওর পাশে আছি। ওর ন্যায্য অধিকার যেন ফিরে পান সে চেষ্টা করছি। জমি বিক্রির টাকা আমার মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে। আর জমির মালিক বিজন জমি বিক্রির টাকা নিয়েছেন বলে স্বীকারও করেছেন। বিজনকে আমি সহ গ্রামবাসী জানিয়েছি এই মাসের মধ্যে জমিটি রেজিস্ট্রি করে দিতে।’ এ বিষয়ে জাকির চেয়ারম্যানের বক্তব্য জানতে চেয়ে উনার ফোনে বেশ কয়েকবার ফোন করলেও উনি মোবাইল ফোন রিসিভ করেননি।