অনলাইন ডেস্ক : বিএনপির দুটি সহযোগী সংগঠনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল। প্রতিষ্ঠার পর শ্রমিক আন্দোলনে খ্যাতি পেলেও এখন অভ্যন্তরীণ সঙ্কট, কোন্দল-গ্রুপিংয়ে জর্জরিত সংগঠনটি। দুই বছর মেয়াদি কমিটি চলছে ১১ বছর ধরে। দীর্ঘ এই সময়ে একাধিকবার উদ্যোগ নিলেও হয়নি কাউন্সিল। সর্বশেষ ২০২০ সালে কাউন্সিলের দিনক্ষণ ঠিক করেও তা হয়নি। নির্ধারিত সময়ে কাউন্সিল না হওয়ায় সংগঠনের পদপ্রত্যাশী ও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ, হতাশ।
এদিকে বিএনপির আন্দোলন সংগ্রামে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন শ্রমিকদলের নেতাকর্মীরা। এমনকি শ্রমিকদের দাবি আদায়েও কার্যত কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেনা সংগঠনটি। কেবল নামমাত্র কিছু কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে দায় সারেন নেতারা।
গার্মেন্টস ও পরিবহন শ্রমিকরা আন্দোলনে কিছুটা ভুমিকা রাখলেও ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ শ্রমিক দলের নেতাকর্মীদের ভুমিকায় নাখোশ নীতিনির্ধারকরা। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, শ্রমিক দলের গঠনতন্ত্রে প্রদত্ত লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সঙ্গে বাস্তব কর্মকাণ্ডের তেমন কোনো সাদৃশ্যও নেই। আন্দোলনের মাঠে করুণ দশা এই সংগঠনটির কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ বিএনপির হাইকমান্ড। গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে পর মূলদলের শূন্যপদ পূরণের পাশাপাশি অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোরও খোঁজখবর নিচ্ছে বিএনপির নীতিনির্ধারকরা।
অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙে দ্রুত সময়ের মধ্যে পুনর্গঠন করা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। অবশ্য বিএনপির চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস দীর্ঘ প্রায় একবছরের বেশি সময় ধরে শ্রমিক দলকে শক্তিশালী করতে নানামুখী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। তিনি কেন্দ্র ও তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মাঝে সমন্বয় করছেন। প্রসঙ্গত, ‘শ্রম দিয়ে শিল্প গড়বো, দেশের আঁধার ঘুচিয়ে দেবো’ স্লোগানে ১৯৭৯ সালের ১ মে এই শ্রমিক দল প্রতিষ্ঠা করেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রয়াত জিয়াউর রহমান বীর উত্তম। শ্রমিকদের বিভিন্ন দাবি আদায় আর উৎপাদন বৃদ্ধি ও আত্মনির্ভরশীল হিসেবে দাঁড় করানোর লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সংগঠনটি।
জানা গেছে, ২০১৪ সালের ১৯ ও ২০ এপ্রিল শ্রমিকদলের জাতীয় কাউন্সিল হয়। সম্মেলনে প্রায় ৮০ ভাগের বেশি কাউন্সিলর নির্বাচনের মাধ্যমে কমিটি গঠনের দাবি তুললে গোলোযোগ হয়। ফলে সেখানে কমিটি গঠন করা সম্ভব হয়নি। সে বছর ৫ মে আনোয়ার হোসাইনকে সভাপতি এবং নূরুল ইসলাম খান নাসিমকে সাধারণ সম্পাদক করে ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি সংগঠনের গঠনতন্ত্র মেনে হয়নি অভিযোগ তুলে শ্রমিকদলের বিরাট একটি অংশ বিদ্রোহ করে। তারা ওই বছরের ৭ জুন এএম নাজিম উদ্দিনকে সভাপতি এবং আবুল খায়ের খাজাকে সাধারণ সম্পাদক করে ৩১ সদস্য বিশিষ্ট পাল্টা কমিটি ঘোষণা দেয়। পরে নাজিম উদ্দিন কমিটিতে না থাকায় আবুল হোসেনকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর শ্রমিকদলের উভয় কমিটিই বৈধভাবে গঠিত হয়নি উল্লেখ করে শ্রম পরিদপ্তরের পরিচালক শ্রম আদালতে চিঠি দেন। এমনকি আনোয়ার-নাসিম কমিটি অবৈধ অভিযোগে আদালতে মামলা করেন বিদ্রোহীরা। তবে ওই মামলা পরবর্তীতে প্রত্যাহার করা হয়। এসব অভ্যন্তীণ সঙ্কটে আন্দোলনে প্রত্যাশা মোতাবেক ভূমিকা রাখতে পারেনি শ্রমিক দল।
সূত্র জানায়, ২০১৮ সালে কারাবন্দি হওয়ার আগে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন ‘ভোটাভুটির মাধ্যমেই শ্রমিক দলের নেতা নির্বাচন করা হবে’। কিন্তু শ্রমিকদলের আনেয়ার-নাসিম কমিটির মেয়াদ ১১ বছরে গড়ালেও আর কাউন্সিল হয়নি। নির্ধারিত সময়ে কাউন্সিল না হওয়ায় সংগঠনের পদপ্রত্যাশী ও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ এবং হতাশ।
শ্রমিকদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম খান নাসিম প্রায় দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে অসুস্থ এবং নিষ্ক্রিয়। নেতাকর্মীরা তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করতে পারেন না। অনেক সময় ফোনেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয় না। সভাপতি আনোয়ার হোসাইনও বয়োজ্যেষ্ঠ। ফলে শ্রমিকদলে এখন নেতৃত্বের সঙ্কট। বিগতদিনে বিএনপির আন্দোলন সংগ্রামে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালনে ব্যর্থ শ্রমিক দল শুধু দিবসভিত্তিক কর্মসূচি পালনেই সীমাবদ্ধ থেকেছে।
এরইমধ্যে ২০২২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ শ্রমিকদলের নতুন আহ্বায়ক (আংশিক) কমিটি দেওয়া হয়। তবে মহানগর কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে মহানগর শ্রমিকদলের বিদায়ী সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে কোনো আলোচনা করা হয়নি বলে অভিযোগ ওঠে।
তৃণমূলের নেতারা জানান, ঢাকা মহানগর কমিটির আগে শ্রমিকদলের কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠন করা বেশি জরুরি ছিল। হঠাৎ করেই মহানগর কমিটিতে যাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাদের যোগ্যতা ও সাংগঠনিক দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। দলের কেন্দ্রীয় এক নেতা বলেন, বিদায়ী কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে নিলে ভালো হতো। নেতৃত্ব বদল হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু যোগ্য লোককে বাদ দিয়ে নতুন কাউকে পদে বসিয়ে দিলেই হয় না। তাছাড়া গত বছরের ২৮ অক্টোবরের পর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ শ্রমিক দলের উল্লেখযোগ্য তৎপরতা দেখাতে পারেনি।
এদিকে শ্রমিকদলে যুগোপযোগী নেতা তৈরির লক্ষ্যে ২০২০ সালের ২১ মার্চ ৮ম জাতীয় কাউন্সিলের দিনক্ষণ নির্ধারণ করেছিল সংগঠনটি। ওই সম্মেলন সফলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমানসহ শীর্ষ ৯ জন নেতাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও শ্রমিকদলের কাউন্সিল নিয়ে একাধিক বৈঠক করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাউন্সিল হয়নি। অবশ্য শ্রমিকদলের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা রেজুলেশনের মাধ্যমে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে কমিটি গঠনের বিষয়ে সার্বিক দায়িত্ব প্রদান করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপির একদফা আন্দোলনে উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা না থাকায় শ্রমিকদলের কর্মকান্ডে বিএনপির হাইকমান্ড অসন্তুষ্ট। অবশ্য একদফা আন্দোলনের আগে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে দেশের বিভিন্ন বিভাগ ও কয়েকটি বড় জেলায় ‘শ্রমিক মেহনতী’ মানুষের পদযাত্রায় শ্রমিক দল কিছুটা ভুমিকা রেখেছে। এর নেপথ্যে ছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী ও শ্রমিক নেতা শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস। তিনি সেসময় শ্রমিক সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বয় করেছেন। তিনি মাঝে-মধ্যে শ্রমিক দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে সভা করেন।
সংগঠনটির নেতারা জানান, সার্বিক দিক বিবেচনায় শ্রমিকদের সংগঠিত করা এবং আন্দোলনে সক্রিয় করতে শ্রমিক দলের নতুন কমিটি করা সময়ের দাবি। এক্ষেত্রে নতুন কমিটির সভাপতি বা সেক্রেটারি হওয়ার লক্ষ্যে পদপ্রত্যাশীরা বিএনপির শীর্ষ নেতা ও কাউন্সিলরদের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখছেন। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে আলোচিত নেতারা হলেন- বিএনপির চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, কেন্দ্রীয় শ্রম বিষয়ক সহ-সম্পাদক হুমায়ুন কবির খান, এএম নাজিম উদ্দিন (চট্টগ্রাম), সাবেক যুগ্ম সম্পাদক আবুল খায়ের খাজা, শ্রমিকদলের উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাবেক সভাপতি কাজী মো. আমীর খসরু, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মঞ্জুরুল ইসলাম মঞ্জু, অর্থ সম্পাদক মো. রফিকুল ইসলাম, সহপ্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মফিদুল ইসলাম মোহনসহ ঢাকা এবং চট্টগ্রাম মহানগরীর কয়েকজন নেতা। তন্মধ্যে হুমায়ুন কবির খান গাজীপুরের কালিয়াকৈর ও নাজিম উদ্দিন চট্টগ্রামে শ্রমিকদের নিয়ে আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন।