
প্রস্তাবনা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আবারও ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে জাতি। ‘জুলাই সনদ’—রাষ্ট্র পুনর্গঠন ও সাংবিধানিক সংস্কারের একটি সম্ভাবনাময় নথি—যা নিয়ে গত কয়েক মাসে দেশের রাজনৈতিক পরিসরে উত্তেজনা, বিতর্ক ও আশঙ্কা একসঙ্গে জমাট বেঁধেছে। সরকার ইতোমধ্যেই এই সনদ বাস্তবায়নের আদেশের খসড়া চূড়ান্ত করেছে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের প্রকাশ্য বিরোধিতা সত্ত্বেও সরকার এখন এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠেছে—জুলাই সনদ কি সত্যিই রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের পথ খুলে দেবে, নাকি তা রাজনৈতিক বিভাজনকে আরও গভীর করবে?
জুলাই সনদের পটভূমি
জুলাই সনদের ধারণা মূলত ২০২৫ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা নিরসনের লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবের ভিত্তিতে উঠে আসে। কমিশনের ৮৪টি প্রস্তাব রাষ্ট্রের কাঠামো, ক্ষমতার ভারসাম্য, ও প্রশাসনিক সংস্কারকে কেন্দ্র করে তৈরি করা হয়।
কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ৯টি প্রস্তাব নির্বাহী আদেশে,
২৭টি প্রস্তাব অধ্যাদেশের মাধ্যমে, এবং
৪৮টি প্রস্তাব গণভোটের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে।
এই সনদ অনুসারে, সংবিধান সংস্কার পরিষদ আগামী সংসদে গঠিত হবে এবং ২৭০ দিনের মধ্যে সংশোধন কার্যকর করতে হবে। ব্যর্থ হলে, জুলাই সনদের ধারাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান
জুলাই সনদের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান একেবারে দ্বিধাবিভক্ত।
বিএনপি বলছে, সরকার এই সনদ ও গণভোট তাদের ওপর “চাপিয়ে দিচ্ছে।” তাদের মূল আপত্তি ‘নোট অব ডিসেন্ট’ (ভিন্নমত) বাদ দেওয়া এবং কিছু প্রস্তাবের মাধ্যমে নির্বাহী ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা।
জামায়াত ও ইসলামি দলগুলো দাবি করছে, ৮৪টি প্রস্তাবের মধ্যে যেগুলোর ওপর আংশিক বা পূর্ণ নোট অব ডিসেন্ট আছে, সেগুলো বাদ দিলে সনদের কোনো মূল্য থাকবে না। তারা জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ছাড়া আগামী জাতীয় নির্বাচন হতে দেবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
অন্যদিকে, সরকার বলছে, দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যে না পৌঁছানোয় জাতীয় স্বার্থে সরকারকেই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।
আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের ভাষায়-
“সব দলের প্রত্যাশা পূরণের চেষ্টা করা হয়েছে। দেশের স্বার্থে ভালো কিছু হবে । সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্ত সব দল মেনে নেবে- এটাই আশা করছি”।
সনদের মূল সংস্কার বিষয়ক প্রস্তাবসমূহ
সনদের প্রস্তাবনাগুলোর মধ্যে কয়েকটি মূল বিষয় বিশেষভাবে আলোচিত—
১. ক্ষমতার ভারসাম্য পুনঃস্থাপন
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা পৃথক করা।
স্বাধীন সংবিধান কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংক, দুর্নীতি দমন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ সার্চ কমিটির মাধ্যমে করা হবে।
২. এক ব্যক্তি এক পদনীতি
একই ব্যক্তি দলের প্রধান, সংসদ নেতা এবং সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না।
৩. উচ্চকক্ষ গঠন (দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ)
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (PR System)-এর ভিত্তিতে উচ্চকক্ষ গঠন।
৪. গণভোট ও সংবিধান সংস্কার
জুলাই সনদের ওপর গণভোট এবং একই দিনে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তাব।
৫. জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ
রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনি ইশতেহারে সনদের ধারাগুলো অন্তর্ভুক্ত করা বাধ্যতামূলক।
বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট : রাজনীতির নতুন টানাপোড়েন
বিএনপি ৮৪টি প্রস্তাবের মধ্যে ১১টিতে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে।
সবচেয়ে বড় ইস্যু হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল।
দলটির যুক্তি—
এই প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন হলে “নির্বাহী শাখা দুর্বল হয়ে যাবে”।
রাষ্ট্রপতির হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা চলে যাবে, যা “অসংবিধানিক ভারসাম্যহীনতা” তৈরি করবে।
অন্যদিকে জামায়াত ও ইসলামি দলগুলো বিএনপির এই অবস্থানকে “জনগণের আকাঙ্ক্ষার বিরোধী” বলে অভিহিত করেছে। ফলে সরকার যেভাবেই হোক একটি মধ্যপন্থা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে।
সরকারের কৌশল ও সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়া
সরকার সূত্রে জানা গেছে, এখন আর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক হচ্ছে না। অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কয়েকজন উপদেষ্টাকে—যাদের মধ্যে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ও জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান অন্যতম।
সরকারের মূল লক্ষ্য হলো, জুলাই সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ নামে একটি নির্বাহী আদেশ জারি করে গণভোটের মাধ্যমে জনগণের রায় নেওয়া।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই আদেশে স্বাক্ষর করতে পারেন।
এই সিদ্ধান্তই সম্ভবত আগামী দিনের রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করবে।
রাজনৈতিক বাস্তবতা : প্রকাশ্য সংঘাত বনাম পর্দার অন্তরাল সমঝোতা
রাজনীতিতে প্রায়ই দেখা যায়, প্রকাশ্যে দলগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষা ব্যবহার করে, কিন্তু পর্দার আড়ালে সংলাপ ও সমঝোতার পথ খোলা থাকে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জুলাই সনদ নিয়েও একই বাস্তবতা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের মতে—
” দলগুলো প্রকাশ্যে কঠোর অবস্থান নিলে ও পর্দার আড়ালে তাড়া নমনীয়। কারণ এর বাইরে তাদের সামনে বাইরে কোন বাস্তব বিকল্প নেই”
ফলে এই সনদ হয়তো অঘোষিত রাজনৈতিক সমঝোতারই রূপান্তর হতে পারে।
বিশ্লেষণ : রাষ্ট্র পুনর্গঠনের সম্ভাবনা ও আশঙ্কা
জুলাই সনদের মূল দর্শন রাষ্ট্রক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, জবাবদিহিতা বৃদ্ধি এবং শাসনব্যবস্থার কাঠামোগত সংস্কারে নিহিত।
কিন্তু বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াটি যদি রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়াই চাপিয়ে দেওয়া হয়, তবে তা আবারও সংঘাতের জন্ম দিতে পারে।
একদিকে জনগণ পরিবর্তন চায়, অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলো সেই পরিবর্তনের শর্তে বিভক্ত।
ফলে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এখন—এই সনদ রাষ্ট্রের সংস্কার আনবে, নাকি নতুন বিভাজন তৈরি করবে?
বাংলাদেশের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—যখনই রাজনৈতিক অচলাবস্থা দীর্ঘ হয়, তখনই রাষ্ট্রব্যবস্থায় সংস্কারের প্রশ্ন ওঠে।
জুলাই সনদ সেই প্রশ্নেরই এক নতুন সংস্করণ।
কিন্তু যে কোনো সংস্কার তখনই সফল হয়, যখন তা রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে।
যদি সরকার এককভাবে এই আদেশ জারি করে, তবে তা হয়তো রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হবে, কিন্তু জনগণের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করবে রাজনৈতিক ঐক্যের ওপর।
তাই এখন সময়—বিরোধ নয়, সংলাপের।
কারণ সংলাপই হতে পারে জুলাই সনদের প্রকৃত আত্মা, আর তার মাধ্যমেই বাংলাদেশের রাষ্ট্র পুনর্গঠনের নতুন অধ্যায় শুরু হতে পারে।
শেষ কথা:
জুলাই সনদ কেবল একটি রাজনৈতিক নথি নয়; এটি হতে পারে নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশের সাংবিধানিক পুনর্জাগরণের নীলনকশা—যদি সব পক্ষ তা ঐক্যের দৃষ্টিতে দেখতে পারে।
— মোহাম্মদ এহছানুল হক ভূঁইয়া
প্রধান সম্পাদক, ধানের শীষ ডট নেট
www.dhanershis.net