==================
মোহাম্মদ এহসানুল হক ভূঁইয়া
==================
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু নির্বাচন: ছাত্রদলের পরাজয় ও শিবিরের উত্থান, ঐতিহাসিক ছাত্র রাজনীতির ধারাবাহিকতায় বিএনপি’র রাজনীতি ঐতিহাসিক ও আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে এক পর্যালোচনা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ডাকসু নির্বাচন কেবল একটি ক্যাম্পাস ইভেন্ট নয়; এটি বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির দীর্ঘ ঐতিহ্য, রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কৌশল, এবং দক্ষিণ এশিয়ার ছাত্র আন্দোলনের বৃহত্তর ধারাবাহিকতার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। শিবিরের ল্যান্ডস্লাইড ভিক্টরি ও ছাত্রদলের পরাজয় এখন রাজনৈতিক বিশ্লেষণের কেন্দ্রে অবস্থান করছে।
ছাত্ররাজনীতির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলন এক অগ্রণী শক্তি।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন: ছাত্রসমাজ আন্দোলনের অগ্রদূত ছিল।
১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা পাকিস্তানি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে বেগবান করে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ: ছাত্র সংগঠনগুলো মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক ভিত্তি গড়ে তোলে ।
১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন: সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল এরশাদ বিরোধী আন্দোলন এবং ফলশ্রুতিতে এরশাদ সরকারের পতন হয়।
২০২৪ সালে ৩৬ শে জুলাই ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন: বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সংঘটিত হয় ছাত্র জনতার সমন্বয়ে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন। ফলশ্রুতিতে শেখ হাসিনা সরকারের পতন।
স্বাধীনতার পর থেকে ডাকসু (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ) ছিল রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম। এখান থেকে উঠে এসেছেন জাতীয় পর্যায়ের বহু নেতা। তবে ১৯৯০-এর দশক পরবর্তী সময়ে ক্রমশ ডাকসু নির্বাচনের স্থবিরতা ছাত্ররাজনীতিকে নতুন রূপ দিয়েছে ।
ডাকসু নির্বাচনের পূর্ববর্তী ধাপ
ডাকসু নির্বাচন দীর্ঘদিন হয়নি; সর্বশেষ নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯০ সালে। দীর্ঘ বিরতির পর নির্বাচনী পরিবেশে ফিরে আসার দাবি দীর্ঘকাল ছাত্রসমাজ তুলে এসেছে।
২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচন আবারো বিতর্কিত হয় প্রশাসনিক পক্ষপাত ও সহিংসতার কারণে।
এবারকার নির্বাচন আরও বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হলো, কারণ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও হলে শিবিরের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে ছাত্রদলের অংশগ্রহণকে অনেকেই “কৌশলগত আত্মঘাত” হিসেবে দেখছেন।
ছাত্রদলের পরাজয়: কারণ ও প্রভাব
১. সংগঠনগত দুর্বলতা: ছাত্রদল দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে শক্তি গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে।
২. প্রশাসনিক বাধা: হলে উপস্থিতি না থাকা এবং প্রচারণার সুযোগ না পাওয়া।
৩. অভ্যন্তরীণ বিভাজন: বিএনপির ভেতরের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও বিভ্রান্তিকর পরামর্শ।
৪. শিবিরের প্রস্তুতি: শিবিরের হলে একচ্ছত্র আধিপত্য ও দীর্ঘমেয়াদি সাংগঠনিক উপস্থিতি।
ফলে ছাত্রদল এই নির্বাচনে বলি হয়েছে, আর শিবির বৈধতা পেয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপট: তুলনামূলক বিশ্লেষণ
বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতিকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতার সাথে তুলনা করলে কিছু সাদৃশ্য ও বৈপরীত্য স্পষ্ট হয়।
ভারত: জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় (JNU) বা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংগঠনগুলো জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাবশালী। তবে ভারতের ছাত্ররাজনীতি তুলনামূলকভাবে বৈচিত্র্যময় এবং শিবির বা একক আধিপত্য সেখানে কম ।
শ্রীলঙ্কা: ইন্টার ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস ফেডারেশন (IUSF) শিক্ষা সংস্কার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রশ্নে কার্যকর ভূমিকা রাখলেও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব প্রবল ।
পাকিস্তান: জামাত-ই-ইসলামী নিয়ন্ত্রিত ইসলামী জামাত-ই-তুলাবা (IJT) বহু বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আধিপত্য বিস্তার করেছে। বাংলাদেশে শিবিরের ভূমিকা I IJTএর মডেলের সাথে অনেকাংশে সাদৃশ্যপূর্ণ ।
এই তুলনা দেখায়, বাংলাদেশের বর্তমান ডাকসু নির্বাচনে শিবিরের উত্থান আঞ্চলিক ধারাবাহিকতারই অংশ।
সর্বশেষ
ডাকসু নির্বাচন আবারো প্রমাণ করেছে যে ছাত্ররাজনীতি কেবল ক্যাম্পাসের ইস্যু নয়, বরং জাতীয় রাজনীতির প্রতিফলন। ছাত্রদলের পরাজয় আসলে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কৌশলগত বিভ্রান্তি ও সংগঠনগত দুর্বলতার ফলাফল।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন রয়ে গেছে:
ছাত্রদলের বলি হওয়ার দায় কে নেবে?
বিএনপি নেতৃত্ব কি এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের জন্য জবাবদিহি করবে?
নাকি এটি ইতিহাসে আরেকটি “অপ্রয়োজনীয় পরাজয়” হিসেবেই থেকে যাবে?
বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার উপর।
লেখক :-
মোহাম্মদ এহসানুল হক ভূঁইয়া
প্রধান সম্পাদক, www.dhanershis.net