২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে সংঘটিত ছাত্র-জনতার সফল গণ-অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে প্রণীত “জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫” একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। এই সনদে রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামো, সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, প্রশাসনিক সংস্কার ও দুর্নীতি দমন প্রক্রিয়ায় গুণগত পরিবর্তনের রূপরেখা দেওয়া হয়েছে। তবে এটি বর্তমানে একটি “খসড়া” বা প্রস্তাবনা মাত্র, যার বাস্তবায়ন নানাবিধ রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। নিচে এর সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা করা হলো:
১. সনদের ইতিবাচক দিক
গণ-অভ্যুত্থানের ফসল: ২০২৪ সালের আন্দোলনে রক্তদানকারী শহীদদের স্মৃতিকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে এটি একটি “জনগণের দাবির প্রতিফলন”।
অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব: ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এবং ৬টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশকে ভিত্তি করে সনদ প্রণয়নের চেষ্টা করা হয়েছে।
বহুদলীয় সমর্থন:
৩৫টি রাজনৈতিক দল ও জোটের মতামত নেওয়া হয়েছে, যা সংশ্লিষ্ট সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারে।
মৌলিক সংস্কারের অঙ্গীকার:
সংবিধান, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন, পুলিশ ও প্রশাসনের দলীয়করণ বন্ধ এবং দুর্নীতি দমনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।
২. বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ
রাজনৈতিক ঐক্যের অভাব: বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজনৈতিক দলগুলো প্রায়শই স্বল্পমেয়াদি স্বার্থে সংস্কার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করেছে। এই সনদ বাস্তবায়নে “দলীয় স্বার্থত্যাগ” প্রয়োজন।
আইনি জটিলতা:
সংবিধান সংশোধন, নতুন আইন প্রণয়ন এবং বিদ্যমান কাঠামো পরিবর্তন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, যা “আদালত ও সংসদীয় বাধার” মুখোমুখি হতে পারে।
প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিরোধ:
দলীয়কৃত প্রশাসন, পুলিশ ও বিচারব্যবস্থা সংস্কারের বিরোধিতা করতে পারে, বিশেষত যারা ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে।
সময়সীমা:
সনদে উল্লিখিত “২ বছরের মধ্যে সংস্কার” বাস্তবায়ন একটি উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য, যা বাস্তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা বা প্রক্রিয়াগত জটিলতায় পিছিয়ে যেতে পারে।
৩. ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের অতীত সংস্কার প্রচেষ্টা (যেমন: ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সংবিধান সংশোধন, ২০০৮ সালের নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলুপ্তি) প্রায়শই **অর্ধ-বাস্তবায়িত** থেকে গেছে। জুলাই সনদও একই ভাগ্য এড়াতে পারে কি না, তা নির্ভর করবে:
নাগরিক সমাজের ভূমিকা:
ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের চাপ বজায় রাখা।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন:
গণতন্ত্র ও সুশাসনে আগ্রহী দেশগুলোর কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা।
সেনাবাহিনীর অবস্থান:
সংস্কার প্রক্রিয়ায় তাদের “নিরপেক্ষতা” নিশ্চিত করা।
৪. সম্ভাব্য ফলাফল
‘সফলতা”: যদি সনদ বাস্তবায়িত হয়, তবে বাংলাদেশে একটি জবাবদিহিমূলক, স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
আংশিক সাফল্য:
যদি শুধু নির্বাচন বা প্রশাসনিক সংস্কার হয়, কিন্তু বিচার বিভাগ বা সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন না হয়, তবে “স্থায়ী পরিবর্তন” আসবে না।
ব্যর্থতা:
রাজনৈতিক কোন্দল, সংস্কার বিরোধী গোষ্ঠীর চাপ বা নাগরিক সমাজের অনীহায় সনদ “কাগজে-কলমে” থেকে যেতে পারে।
৫. উপসংহার
জুলাই সনদ একটি “আশাবাদী দলিল'”, কিন্তু এর বাস্তবায়ন নির্ভর করবে “রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছা, নাগরিকদের সক্রিয়তা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতার” উপর। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি একটি “টার্নিং পয়েন্ট” হতে পারে।
যদি না এটি আরেকটি “অবাস্তবায়িত স্বপ্ন” হয়ে থাকে।
“স্বপ্ন দেখাই প্রথম পদক্ষেপ, কিন্তু স্বপ্ন পূরণের জন্য সংগ্রামই শেষ কথা।”
জুলাই সনদের ভবিষ্যৎ এই সংগ্রামের ওপরই নির্ভর করছে।
লেখক : মোহাম্মদ এহসানুল হক ভূঁইয়া
প্রধান সম্পাদক, ধানের শীষ ডটনেট
www.dhaershis.net