
মোহাম্মদ এহছানুল হক ভূঁইয়া
প্রধান সম্পাদক, ধানের শীষ ডট নেট
www.dhanershis.net
ভূমিকা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৭৫ এবং ২০২৪—দুটি বছর দুই ভিন্ন যুগের হলেও তাদের মধ্যে আশ্চর্য মিল রয়েছে:
উভয় বছরই একদলীয় ক্ষমতার পরিণতি, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিপর্যয়, জনঅসন্তোষের বিস্ফোরণ এবং জাতীয় নেতৃত্বের নাটকীয় পতনের সাক্ষী।
১৯৭৫ সালে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এক বিশৃঙ্খল অন্ধকারে প্রবেশ করে। অপরদিকে, ২০২৪ সালে দীর্ঘমেয়াদি শাসনের পর শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন, নিখোঁজ–খন্খার অভিযোগ ও প্রাণহানির ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে জনআন্দোলন তীব্র হয় এবং অবশেষে তার দেশত্যাগ ও বিচারের মুখোমুখি হওয়ার প্রশ্ন সামনে আসে।
১. ১৯৭৫: শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যা ও আওয়ামী লীগের প্রথম পতন
১-১. পটভূমি: একদলীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও অসন্তোষ
১৯৭২–৭৫ পর্যায়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ, প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক সংঘাত প্রচণ্ড ছিল। ১৯৭৫ সালে “বাকশাল” প্রবর্তন, রাজনৈতিক দল স্থগিতকরণ এবং সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত সশস্ত্র বাহিনী ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মধ্যে বিরূপতার সৃষ্টি করে।
১-২. ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ড
২৬ বছর বয়সী কিছু সেনা কর্মকর্তা রাষ্ট্রীয় অভ্যুত্থান ঘটিয়ে শেখ মুজিব ও তার পরিবারের অধিকাংশকে হত্যা করে।
রাষ্ট্রযন্ত্র ভেঙে পড়ে, এবং দলের নেতৃত্ব স্তব্ধ হয়ে যায়।
বাঙালি জাতির ইতিহাসে এটি ছিল সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রিক ধাক্কাগুলোর একটি।
৩. আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক পতন ও রাজনৈতিক নির্বাসন
দল নিষিদ্ধ হয় না, কিন্তু প্রভাবশালী ভূমিকায় ফিরতে পারে না।
নেতৃত্ব দেশান্তরী হয়—এর মধ্যে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকেন।
পরবর্তী সামরিক শাসন (মোশতাক, জিয়া, এরশাদ) আওয়ামী লীগকে নিয়ন্ত্রণে রাখে।
এটি ছিল দলের প্রথম বৃহৎ পতন।
২. ২০২৪: দীর্ঘমেয়াদি শাসনের পর শেখ হাসিনার সরকারের পতন
১. পটভূমি: ২০০৯–২০২৪ ক্ষমতার কেন্দ্রীয়করণ
দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনামলে—
পুলিশ, র্যাব, গোয়েন্দা সংস্থা ও প্রশাসনে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ,
বিরোধী দল দমন, একাধিক বিতর্কিত নির্বাচন, নাগরিক স্বাধীনতার সংকোচন নিয়ে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ মহলে কঠোর সমালোচনা বৃদ্ধি পায়।
২. মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নিখোঁজ–খন্খার অভিযোগ
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন বহু বছর ধরে নিম্নলিখিত বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এসেছে—
বিচারবহির্ভূত হত্যা, জোরপূর্বক নিখোঁজ, কারাগারে নির্যাতন, রাজনৈতিক মামলা এগুলো ২০২৪ সালে “গণহত্যা” অভিযোগের কাঠামো তৈরির দিকে আলোচনাকে নিয়ে যায়।
* এই অভিযোগগুলো এখনো আইনি প্রমাণের পর্যায়ে।
৩. ২০২৪ সালের আন্দোলন ও সরকারের পতন
জুলাই-আগস্ট ২০২4-এ ছাত্র-নেতৃত্বাধীন ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়—
বেকারত্ব, বৈষম্য, দুর্নীতি, কোটা সংকট এবং পুলিশি দমন এর বিরুদ্ধে।
সহিংসতায় ছাত্র–যুবকের মৃত্যু জনরোষকে চরমে নিয়ে যায়। বৃহৎ গণঅসন্তোষ, নিরাপত্তা বাহিনীর বিভাজন, আন্তর্জাতিক চাপে অবশেষে আগস্টে শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যায়।
৩. গণহত্যার অভিযোগ: আইনি কাঠামো, প্রমাণ ও বিচারিক প্রক্রিয়া
৩-১. অভিযোগের প্রকৃতি
“গণহত্যা” শব্দটি আন্তর্জাতিক আইনে অত্যন্ত কঠোর ও সীমাবদ্ধ — জাতিগত, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ইত্যাদি পরিচয়কে লক্ষ্য করে সংগঠিত বৃহৎ হত্যাকাণ্ড।
বাংলাদেশে ২০২৪ সালের ঘটনায়— সরকারি বাহিনীর গুলি, প্রতিরোধহীন জনগণের মৃত্যু, মিছিল–মিটিংয়ে হামলা এই ঘটনাগুলোকে কেউ কেউ “গণহত্যা সদৃশ” হিসেবে বর্ণনা করলেও, এটি এখনো যাচাইবাছাইয়ের অধীন অভিযোগ।
৩-২. সম্ভাব্য বিচার ব্যবস্থার পথ
বিচার হতে পারে তিনভাবে:
১. দেশীয় ট্রাইব্যুনাল
২. আন্তর্জাতিক কমিশন অব ইনকোয়ারি
৩. ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (ICC)—যদি রাষ্ট্র নিজে উদ্যোগ নেয়
বাংলাদেশ সরকার ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট আই সি সি আইনের উপর ভিত্তি করেই শেখ হাসিনা এবং তার সভাসদ ও পেটুয়া আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্তাদের বিচার হবে।
বিচার পেতে হলে প্রয়োজন— সুনির্দিষ্ট প্রমাণ, চেইন অব কমান্ড, প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান, ফরেনসিক বিশ্লেষণ।
৩-৩. রাজনৈতিক বিতর্ক
শেখ হাসিনার সমর্থকেরা বলেন— আন্দোলন সশস্ত্র ছিল, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনে বল প্রয়োগ হয়েছে, অভিযোগগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
বিরোধীরা বলেন— রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ব্যবহার করে পদ্ধতিগত দমন চালানো হয়েছে, এটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরম উদাহরণ।
সত্যনির্ধারণ করতে তাই নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক মানের তদন্ত জরুরি।
৪. ১৯৭৫ ও ২০২৪: মিল, অমিল এবং ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি
মিল
ক্ষমতার অত্যধিক কেন্দ্রীকরণ, অসম্ভব রাজনৈতিক মেরুকরণ, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা, বিরোধী কণ্ঠর দমন, জনঅসন্তোষ বিস্ফোরণ, নেতৃত্বের আকস্মিক পতন।
অমিল
১৯৭৫ ছিল সামরিক অভ্যুত্থান; ২০২৪ ছিল গণআন্দোলননির্ভর রাজনৈতিক পরিবর্তন।
১৯৭৫-এ পরিবারসহ নির্মম হত্যাকাণ্ড; ২০২৪-এ হত্যাকাণ্ড নয়, বরং দেশত্যাগ ও অভিযোগের মুখোমুখি হওয়া।
১৯৭৫ ছিল দল-রাষ্ট্র ধ্বংসের সূচনা; ২০২৪ একটি নতুন রাজনৈতিক পুনর্গঠনের সম্ভাবনা।
৫. ভবিষ্যৎ: রাষ্ট্র, রাজনীতি ও ন্যায়বিচারের প্রশ্ন
৫.১. বাংলাদেশ কি রাজনৈতিক প্রতিশোধ থেকে বেরোতে পারবে?
ইতিহাস বারবার প্রতিহিংসার চক্র দেখিয়েছে। এবার কি আইন ও প্রতিষ্ঠান-নির্ভর রাষ্ট্র গড়ে উঠবে?
৫-২. আওয়ামী লীগ কি নতুন রূপে ফিরে আসবে?
৭৫-এর পর যেমন পুনর্গঠন হয়েছিল, ২০২৪-এর পরও দলটির টিকে থাকা ও পুনরাবিষ্কার সময়ের ব্যাপার।
৫-৩. ন্যায়বিচার কি নিরপেক্ষ হবে?
গণতন্ত্র রক্ষা করতে হলে রাজনৈতিক স্বার্থের বাইরে বিচার নিশ্চিত করা জরুরি।
৫-৪. একটি নতুন সামাজিক চুক্তি কি জন্ম নেবে?
রাষ্ট্র-নাগরিক সম্পর্ক পুনর্গঠনই পরবর্তী দশকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
সমাপ্তি
১৯৭৫ ও ২০২৪—দুটি বছরই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য টার্নিং পয়েন্ট।
একদিকে—একটি রাজনৈতিক পরিবারকে টেনে নামানো, অন্যদিকে—ঐ একই পরিবারের বিরুদ্ধে নতুন যুগের অভিযোগ ও বিচারিক প্রশ্ন।
ইতিহাসের এই বাঁকে প্রয়োজন—সত্যের অনুসন্ধান, আইনসম্মত বিচার, দেশকে নতুন করে গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে দাঁড় করানো।
অতীতের ক্ষত যদি নিরপেক্ষভাবে নিরাময় না হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ আবারও একই দুঃচক্রে আটকে যাবে।