
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা গত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করলেও আজও এটি কাঠামোগত দুর্বলতা, প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি এবং বেসরকারীকরণের অপ্রতুল ভারসাম্যের সংকটে ভুগছে। এ প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা, উন্নয়নকর্মী ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ড. জিয়া হায়দার ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য এক নতুনতর জনস্বাস্থ্যভিত্তিক উন্নয়ন মডেল প্রস্তাবের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন। তাঁর নীতি–দর্শনে স্বাস্থ্যকে দেখা হচ্ছে শুধু চিকিৎসা নয়, বরং মানবসম্পদ উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়বিচারের মূল স্তম্ভ হিসেবে।

ড. জিয়াউদ্দিন হায়দারের পেশাগত ও দৃষ্টিভঙ্গির পটভূমি-
ড. জিয়া হায়দার দীর্ঘদিন বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করেছেন। তাঁর অভিজ্ঞতার মূল ক্ষেত্র ছিল— মানবসম্পদ উন্নয়ন (Human Capital Development), স্বাস্থ্য অর্থনীতি (Health Economics), সামাজিক নিরাপত্তা ও দারিদ্র্য বিমোচন, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি (Institutional Strengthening)।
এই পটভূমিই তাঁকে বাংলাদেশের জন্য একটি সমন্বিত স্বাস্থ্যনীতি কল্পনা করার সুযোগ দিয়েছে, যা কেবল হাসপাতাল নির্মাণ বা ওষুধ সরবরাহে সীমিত নয়, বরং প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যচর্চা ও স্থানীয় পর্যায়ের অংশগ্রহণমূলক নীতিতে ভিত্তিক।
বাংলাদেশের বর্তমান স্বাস্থ্যখাত: একটি বাস্তব চিত্র
বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতের কাঠামো তিনটি প্রধান স্তরে বিভক্ত —
০১. প্রাথমিক (Primary Health Care) – ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ের কেন্দ্রসমূহ
০২. মাধ্যমিক (Secondary) – জেলা হাসপাতাল ও বিশেষায়িত কেন্দ্র
০৩. তৃতীয়িক (Tertiary) – মেডিকেল কলেজ ও জাতীয় হাসপাতালসমূহ
তবে বাস্তবতায় দেখা যায়:
সরকারি বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ০.৯%, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্নের অন্যতম।
ডাক্তার-রোগী অনুপাত প্রায় ১:১৮০০, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ডের নিচে।
স্বাস্থ্যসেবায় বেসরকারি খাতের আধিপত্য ও চিকিৎসা ব্যয়ে জনগণের উচ্চমাত্রার “out-of-pocket expenditure” (৭০% এর বেশি) নাগরিকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে বিপন্ন করছে।
ড. জিয়াউদ্দিন হায়দারের প্রস্তাবিত স্বাস্থ্য–দর্শন: “Inclusive Health Growth”
ড. হায়দার বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন টেকসই হবে তখনই, যখন স্বাস্থ্যকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সমন্বিত করা হবে। তাঁর দৃষ্টিতে, নীতির মূল ফোকাস হওয়া উচিত —
প্রতিরোধমুখী (Preventive) স্বাস্থ্যনীতি:
রোগ হওয়ার পর চিকিৎসা নয়, বরং আগে থেকেই স্বাস্থ্যঝুঁকি হ্রাস।
পুষ্টি ও মাতৃস্বাস্থ্য কর্মসূচি, মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা
প্রযুক্তিনির্ভর স্বাস্থ্যব্যবস্থা (Digital Health System):
ই-হেলথ কার্ড, টেলিমেডিসিন, কেন্দ্রীভূত স্বাস্থ্য তথ্যভান্ডার
অংশগ্রহণমূলক স্বাস্থ্যশাসন (Community Health Governance):
স্থানীয় প্রশাসন ও জনগণের অংশগ্রহণ, ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্য কমিটি, নারী ও যুব সংগঠনের অন্তর্ভুক্তি
জনস্বাস্থ্য অর্থায়নের পুনর্বিন্যাস (Health Financing Reform):
সরকারি স্বাস্থ্য বাজেট জিডিপির কমপক্ষে ৩% পর্যন্ত বৃদ্ধি, জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা ব্যবস্থা, দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্য ভর্তুকিনির্ভর চিকিৎসা সুবিধা,
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার আলোকে তুলনামূলক দৃষ্টান্ত
ড. হায়দারের পরিকল্পনা আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ —
থাইল্যান্ডের “Universal Coverage Scheme” – সাধারণ জনগণের জন্য সর্বজনীন চিকিৎসা বীমা
ভিয়েতনামের কমিউনিটি হেলথ ইনফ্রাস্ট্রাকচার – গ্রামীণ চিকিৎসা ব্যবস্থার শক্তিশালী নেটওয়ার্ক
রুয়ান্ডার “Mutuelle de Santé” – স্বল্প আয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য সহনীয় প্রিমিয়ামে স্বাস্থ্যসেবা
বাংলাদেশও এই মডেলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে স্থানীয় বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে।
নীতি–গঠন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা
স্বাস্থ্যনীতি শুধু প্রশাসনিক দলিল নয়, এটি রাজনৈতিক অঙ্গীকারের প্রতিফলন। বিএনপির উপদেষ্টা হিসেবে ড. জিয়া হায়দার এই বার্তাই দিতে চান—
“জনগণের স্বাস্থ্যই জাতীয় নিরাপত্তার মূলভিত্তি।”
তাঁর নীতির লক্ষ্য হলো —চিকিৎসাকে নাগরিক অধিকার হিসেবে সংবিধানে শক্তভাবে প্রতিস্থাপন, চিকিৎসক সমাজ ও জনস্বাস্থ্যকর্মীদের প্রণোদনা বৃদ্ধি, ওষুধনীতি ও গবেষণায় স্বনির্ভরতা প্রতিষ্ঠা।
সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
সম্ভাবনা:
প্রযুক্তিগত সক্ষমতা, তরুণ ডাক্তারদের আগ্রহ, ও এনজিও খাতের সক্রিয়তা।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা (বিশ্বব্যাংক, WHO, DFID) পুনরায় সক্রিয় করা।
চ্যালেঞ্জ:
প্রশাসনিক জটিলতা ও দুর্নীতি, স্বাস্থ্যখাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, প্রশিক্ষিত মানবসম্পদের অভাব, দীর্ঘমেয়াদী নীতির ধারাবাহিকতার ঘাটতি।
শেষাংশ:
ড. জিয়াউদ্দিন হায়দারের প্রস্তাবিত “Inclusive Health Growth” বা অন্তর্ভুক্তিমূলক স্বাস্থ্য উন্নয়ননীতি বাংলাদেশের জন্য এক বাস্তবসম্মত ও মানবমুখী পথনকশা হতে পারে। এটি কেবল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাঠামোগত সংস্কার নয়, বরং জাতির মানসিক ও অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণের ভিত্তি গড়ে দিতে সক্ষম।
বাংলাদেশ যদি এই নীতির মূল দর্শন- “স্বাস্থ্যই মানবসম্পদ, মানবসম্পদই উন্নয়ন” — অনুসরণ করে, তবে আগামী দশকে দেশটি দক্ষিণ এশিয়ার এক স্বাস্থ্যসমৃদ্ধ ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রের মডেল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে।
মোহাম্মদ এহছানুল হক ভূঁইয়া
প্রধান সম্পাদক, ধানের শীষ ডট নেট
www.dhanershis.net
প্রধান সম্পাদক : মোঃ এহছানুল হক ভূঁইয়া, প্রকাশক : মোঃ হাসান আলী রেজা (দোজা)
সম্পাদক : মোহাম্মদ মনির হোসেন কাজী
সম্পাদকীয় কার্যালয়: টেক্সাস, ইউ. এস. এ, ফোন : +𝟏 (𝟗𝟕𝟐) 𝟐𝟎𝟏-𝟖𝟔𝟗𝟒
বাংলাদেশ অফিস : ৩৪০/এ, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী, ঢাকা-১২০৪।
বাংলাদেশ যোগাযোগ : +88-01511461475, +88-01911804581